সামাজিকতার রকমফের!
সেদিন রাতে জয়িত আপার একটা স্ট্যাটাসের সূত্র ধরে আমি, শুভ ভাই আর মাসুম ভাই মিলে অনেকক্ষণ ফেসবুকে গ্যাঁজাইলাম। পরদিন সকালে অফিসে কলিগদের সাথে নাগরিক সম্পর্কের বহুমাত্রা, টানাপোড়েন কিংবা সম্পর্কহীনতা ইত্যাদি নিয়ে কথা হচ্ছিল। একটু বয়স্ক ধরনের কলিগদের মত হলো- ইন্টারনেট জীবন মানুষকে ‘আনস্যোশাল’ করে ফেলছে। মাঝারি বয়সের কলিগরা দোনামোনা করে সেটাকে মানলেও আমার মতো বাচ্চা-কলিগরা কিছুটা প্রতিবাদই করলাম। সম্পর্ক কিংবা সামাজিকতা আসলে প্রেক্ষাপটের ব্যাপার- বছর দশেক আগেও মার সাথে মোবাইলে কথা হতো না, দু-তিন মাসে একটা চিঠি এবং চারপাঁচ মাসে একবার দেখা। আর এখন প্রায় প্রতিদিনই কথা হয়- কিন্তু দুবেলাতেই সম্পর্কটা একই জায়গাতে রয়ে গেছে, বদলেছে কেবল যোগাযোগ ধরন কিংবা মিথস্ক্রিয়ার মাত্রাটুকু। চেনা আর জানার মধ্যে যতোটুকু পার্থক্য- তাতে শুভ ভাই, জয়িতা আপা কিংবা মাসুম ভাইকে আমি জানি না, সামান্য চিনি। কিন্তু আমি জানি না, তাদের ভাইবোন কতোজন, বাড়ি কোথায়, বাবা-মা কী করেন, ইভেন বয়ফ্রেন্ড বা গার্লফ্রেন্ড আছে কিনা (মাসুম ভাই বিবাহিত সেইটা অবশ্য জানা আছে)। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, আড্ডা দিতে কিংবা খুনসুটি করতে এই তথ্যগুলোর খুব একটা দরকার পড়ছে না। কয়েক দিনের দেখা কিংবা হালকাচালের কথাবার্তা থেকেই এ সময়ের আমরা পরস্পরকে বুঝে নিচ্ছি যদিও বুঝে নেয়ার তীব্রতাটা খুব গভীর নয়। বরং ব্যক্তিগত তথ্যের বদলে ব্লগের লেখনীর মাধ্যমে তাঁদের চিন্তাধারা এবং কর্মপরিধিটার সাথেই নিজেরটা মিলিয়ে নিচ্ছি এবং বটমলাইনটা ঠিক থাকলেই আপন বলে ভেবে নিচ্ছি। রক্ষণশীল মন হয়তো প্রশ্ন করতে পারে (যেটা বয়স্ক কলিগদের মূল কনসার্ন)- না জেনে না শুনে কারোর সাথে মেলামেশাটা কতোখানি উচিৎ? কিন্তু আমার মতে, বর্তমান সময়ের মিথস্ক্রিয়ার মূল কনসেপ্টটাই বছর বিশেক আগের থেকে পরিবর্তিত- ব্যক্তিগত তথ্যের আলোকে একী-মনস্ক হওয়ার বদলে চিন্তাভাবনার ঐক্য এ সময়কার সামাজিকতার মূল সূত্র হয়ে উঠছে। সুতরাং এ সময়কালের মানুষদের যারা ‘আনস্যোশাল’ বলছেন, তারা সম্ভবত তাদের ‘স্যোশাল’-এর মস্তিস্কগ্রথিত চিন্তাটুকুকে শিরোধার্য করেই কথাগুলো বলছেন। সামাজিকতার বড় সূত্র যোগাযোগ- কিন্তু সেখানে শরীর অবশ্য-বাঞ্ছনীয় নয়।
আমি কখন চাইলাম?
‘বিশ্বাস-বিশেষজ্ঞ’ হিসেবে হাজী মো. সেলিম ইতোমধ্যে বিখ্যাত হয়ে উঠছেন যদিও আমি ঠিক নিশ্চিত নই তিনি আসলে কীসের কথা বলতে চাইছেন! তিনি বিশ্বাসে বিশ্বাস করেন, কিন্তু সেখানে বিশ্বাসের ভিত্তিটা কী সেটা পরিষ্কার নয়। তবে বলা ভালো- ঘুরেফিরে সব বিশ্বাসকেই হাজী মো. সেলিম নিজস্ব বিশ্বাসের আওতায় ফেলে এক বিশ্বাসময় জীবনের প্রতিচ্ছবি আঁকতে চাইছেন যেখানে তাঁর প্রতি বিশ্বাসের ভিত্তিতে মানুষ নিজের বিশ্বাসগুলোকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইতে পারে ঢাকার উন্নয়ন-বিশ্বাসের ধারণায় যখন জনগণের বিশ্বাসটুকু নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির বিশ্বাসের পুঁজি হয়ে উঠে। সে পর্যন্ত সমস্যা ছিল না, কিন্তু আজকের বিডিনিউজে তিনি বলেছেন, জনগণ চাচ্ছে বলেই তিনি প্রচারণা চালাচ্ছেন যদিও আঁতিপাতি করে বুঝতে পারলাম না জনগণের একজন হিসেবে আমি কখন চাইলাম। নিজে থেকে তো চাই-ই নি, কেউ এসেও কখনও জিজ্ঞাসা করে নি। সুতরাং এক্ষণে আমি আমার ডিসক্লেইমারটা দিয়ে রাখলাম যে- শুধু হাজী মো. সেলিম নন, কারো ক্ষেত্রেই এখন পর্যন্ত আমি চাই নি। সুতরাং নির্বাচনে ইচ্ছুক ব্যক্তিবর্গ কথা বলার সময় চাইলে ‘জনগণের সবাই কেবল একজন ছাড়া’ বললে বক্তব্যটা আরেকটু স্পেসিফিক ও গ্রহণযোগ্য হবে বলে মনে করার বদলে এখানে বিশ্বাস করছি।
মৃত্যুচিন্তা
মৃত্যুচিন্তা সম্পর্কে সর্বপ্রথম ভয়ের অনুভূতি জন্মায় ছেলেধরার গুজবে- যখন আমি নেহায়তেই হাফপ্যান্ট পড়ি এবং প্রায়ই চেইন ছেঁড়া থাকে বলে পোস্টাফিস দেখা যায়। পরবর্তী সময়ে বইয়ে বীরশ্রেষ্ঠদের কাহিনী পড়ে পড়ে মনে হয়েছিল- মৃত্যু নেহায়েতই খারাপ না, কারণ ধরেন যুদ্ধ করে মরলে বইয়ে নাম থাকবে আমার ছেলে-মেয়ে-নাতি-পুতিরা আমার নামটা পড়তে পারবে (তখন পর্যন্ত বিয়ের সাথে ছেলেমেয়ের সম্পর্কটা আবিষ্কৃত হয় নি আমার মনে)। ভয়টা চূড়ান্ত রূপ পেল তখনই যখন কীর্তন উপলক্ষে কেনা পোস্টারে দেখলাম অসুররা নরকে পাপীদেরকে কড়াইতে গরম তেলে ভাজতেসে কিংবা এদিক-ওদিক দিয়ে (মূলত পেছন দিক দিয়ে) লোহার চুক্ষা ডান্ডা ঢুকাইতেছে। মহাবিশ্বের ইতিহাস পড়ে যখন দেখলাম অসুররা আসলে কিছুই করতে পারবে না- তখন মৃত্যুচিন্তা নতুনরূপে আসন গেড়ে বসলো- একটা হাহাকারের ধ্বনি নিয়ে- এই পৃথিবীতে আমি থাকবো না, কিন্তু কারিনা কাপুররা নেচেগেয়ে বেড়াবে- এইটা কিছু হইল! এই মৃত্যু তো আমি চাই না। পরকালে ৭০টা কেন, ৭০০০০-ও আমার দরকার নাই, যতোটা দরকার এই কালে। আমার ধর্মগ্রন্থে পরকালে মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট বা এসির কথা বলা নাই। সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হলো, আমার মরার পর কোটি কোটি মানুষ বোয়াল মাছের ঝোল খাবে তাড়িয়ে-তাড়িয়ে, রাস্তার পাশের দোকান থেকে কাপের পর কাপ চা মানুষে উজাড় করে দিবে কিংবা রাতে বউয়ের সাথে টাংকি মেরে ছুটির দিন দুপুর একটা পর্যন্ত ঘুমাবে!- আর সেখানে আমার কোনো অস্তিত্বই থাকবে না!
মৃত্যুচিন্তা বড়ই খতরনাক কিন্তু ধরুন দেখি এই মুহূর্তে আমার মৃত্যু হয়ে গেলে এই দুনিয়ার কী এসে যাবে? নানা হিসাবনিকাশে দেখলাম- ‘এই পৃথিবীর শোকের আয়ু দণ্ডতরে!’ থাক, লেখাটা শেষ করতে গিয়াও করলাম না! সব কথা বলতে নাই।