এ সপ্তাহে দু-দুটো গুরুত্বপূর্ণ পাবলিক পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হলো। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণীর পড়ালেখা শেষ করার পর শিক্ষার্থীদেরকে যথাক্রমে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা এবং জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) বা জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট (জেডিসি) পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়। দুটো পরীক্ষাই তুলনামূলকভাবে নতুন হলেও সেগুলো যথেষ্ট সাড়া জাগিয়েছে। বিশেষত এসএসসি কিংবা এইচএসসি পরীক্ষার আদলে অনুষ্ঠিত হওয়া এই নতুন পাবলিক পরীক্ষাগুলো শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকদের কাছে সমাদৃত হয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। এবার প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় পাশের হার ৯৭ শতাংশ (এবতেদায়ীতে ৯১ শতাংশ) এবং জেএসসি/জেডিসিতে ৮৩ শতাংশ ছাড়িয়েছে। শিক্ষার্থীদের এই পাশের হার যথেষ্টই আশাপ্রদ এবং তারা যদি এ ধরনের ফলাফল ভবিষ্যতে ধরে রাখতে পারে, তাহলে তা দেশের জন্যই মঙ্গলজনক হবে। যে সমস্ত শিক্ষার্থী এবারের প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা এবং জেএসসি/জেডিসিতে উত্তীর্ণ হয়েছে তাদের সবাইকে অভিনন্দন। অভিনন্দন তাদের শিক্ষক ও অভিভাবকদেরও, যাদের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় আজকের এই সফলতা। অন্যদিকে বিভিন্ন কারণে যারা পরীক্ষার আগেই ঝরে পড়েছে কিংবা পরীক্ষা দিয়েও উত্তীর্ণ হতে পারে নি, তাদের জন্যও শুভকামনা রইলো। নিশ্চয়ই তারা আগামীবার চমকপ্রদ ফলাফল করে সবাইকে দেখিয়ে দিবে যে, এবারের ফলাফলটা নেহায়েৎই দুর্ঘটনা!
এবারের পরীক্ষাদুটোর ফলাফল বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায়, সারা দেশে পাশের হার যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে জিপিএ ৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাও। শতভাগ পাশ করা বিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়েছে। অন্যদিকে কমেছে শতভাগ ফেল করা বিদ্যালয়ের সংখ্যাও। তবে মেয়েদের তুলনায় ছেলেরা এবার তুলনামূলকভাবে ভালো ফলাফল করেছে। বিদ্যালয়ের পারফরম্যান্স মাপার জন্য শিক্ষা বিষয়ক মন্ত্রণালয়গুলোর কিছু নির্দিষ্ট সূচক রয়েছে যার মধ্যে পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে শতভাগ পাশ করার সূচকটি অন্যতম। সেদিক দিয়ে আমাদের বিদ্যালয়গুলোর অবস্থা দিন দিন ভালো হচ্ছে- তা বলতেই হবে। এদেশে পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে একসময় নকলের মহোৎসব হলেও সাম্প্রতিক সময়ে নকলের প্রবণতা একেবারেই কমে গেছে। এজন্য সংশ্লিষ্ট সবাই ধন্যবাদ পাবার যোগ্য। নকলমুক্ত পরীক্ষা ও গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করার যে দায়িত্ব সরকারের, সেখানে পুরোপুরি সফলতা আসতে এখনো অনেক দেরি; তবে এই বিষয়গুলোতে সরকারের প্রচেষ্টা সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য।
উপরের কথাগুলোর পাশাপাশি এ দুটো পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে কিছু সংশয়ের কথাও এখানে বলা দরকার। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখা যাচ্ছে, যে কোনো পাবলিক পরীক্ষাতেই শিক্ষার্থীদের পাশের হার উল্লেখযোগ্য হারে প্রতি বছরই বাড়ছে। পরীক্ষা অংশ নেয়া প্রত্যেক শিক্ষার্থীই পাশ করুক- এটা সবারই চাওয়া। কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষার যে বাস্তব চিত্র প্রতিনিয়ত আমরা অবলোকন করি, তাতে কি এটাকে বাস্তবসম্মত মনে হয়? বাংলাদেশের শিক্ষার মান নিয়ে অনেক কথাবার্তা বলা হয়। প্রাথমিক শ্রেণীতে ভর্তি কিংবা ঝরে পড়ার হার কমানো- এই ক্ষেত্রগুলোতে অনেকটা সাফল্য আসলেও দেশের শিক্ষার মান যে উল্লেখযোগ্য হারে বদলে যায় নি, সেটা সম্ভবত সবাই অনুধাবন করি। যদি তাই হয়, তাহলে এতো বিপুল শিক্ষার্থী পাশ করে কীভাবে? প্রতি বছর জিপিএ ৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে। এবার জেএসসি/জেডিসিতে গত বছরের তুলনায় তিন গুণ বেশি শিক্ষার্থী এই জিপিএ ৫ পেয়েছে। গত বছরের সাপেক্ষে এবারের শিক্ষায় এমন কি কোনো পরিবর্তন এসেছে যাতে জিপিএ ৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের সংখ্যা তিন গুণ বেড়ে যেতে পারে?
এসব পাবলিক পরীক্ষার খাতা কীভাবে মূল্যায়ন করা হবে, সে সম্পর্কে শিক্ষকদের নিকট সুস্পষ্ট নির্দেশনা যায় মন্ত্রণালয় বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে। খাতা মূল্যায়নের ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক সময়ে কিছু কিছু পরিবর্তন এসেছে। এখন পরীক্ষার খাতা দেখে বুঝার উপায় নেই কোনটি কার খাতা বা কোন বিদ্যালয়ের খাতা। ফলে পরীক্ষকের পক্ষপাতদুষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটা কমেছে আগের তুলনায়। কিন্তু শিক্ষার্থীদের খাতা তুলনমূলকভাবে সহজ করে দেখার কি কোনো নির্দেশনা থাকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে? কিংবা পাবলিক পরীক্ষার জন্য যে মানের প্রশ্নপত্র তৈরি করা দরকার, প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা বা জেএসসি/জেডিসিতে কি সেই মান অনুসরণ করা হয়? নাকি তুলনামূলকভাবে সহজ প্রশ্ন করা হয় যাতে শিক্ষার্থীরা সহজেই ভালো ফলাফল করতে পারে? এই বিষয়গুলো আরো বেশি বেশি আলোচিত হওয়া দরকার। এগুলো নিয়ে বিশেষভাবে গবেষণা হওয়া দরকার। গবেষণা থেকে যদি সত্যিই দেখা যায়, আমাদের শিক্ষার্থীরা এমন বিপুল পরিমাণ পাশের জন্য প্রতিনিয়ত যোগ্য হয়ে উঠছে, তাহলে সেটি অবশ্যই দেশের জন্য সুখবর হবে। দেশে রাজনৈতিক কারণে পরীক্ষার পাশের হার বাড়িয়ে দেয়ার ঘটনা যে অতীতে ঘটে নি বা বর্তমানে ঘটছে না, সে ব্যাপারে অনেকেরই সন্দেহ রয়েছে। কোনো সরকারই চায় না, তার আমলে পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল খারাপ হোক; কারণ তাতে পরবর্তী সরকার কিছু কথা বলার সুযোগ পেয়ে যায়। ফলে এক্ষেত্রে ইচ্ছাকৃতভাবে ফলাফল ভালো দেখানোর ঘটনা ঘটলেও ঘটতে পারে। এসব কারণেই এই বিষয়গুলো নিয়ে গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।
ফলাফলের পাশাপাশি যে সমস্ত শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিতে পারে নি কিংবা পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ফেল করেছে, তাদের ব্যাপারেও আলোচনা হওয়া দরকার। যেহেতু পাবলিক পরীক্ষাগুলো অনুষ্ঠিত হয় সদর উপজেলার নির্দিষ্ট সেন্টারে, সুতরাং প্রত্যন্ত এলাকার অনেক শিক্ষার্থীর অভিভাবকের পক্ষে সদরে এসে পরীক্ষায় অংশ নেয়ার মতো সামর্থ্য থাকে না। ঠিক একই কারণে অনেক শিক্ষার্থী একটি বা দুটি পরীক্ষা দিয়ে ঝরে পড়েছে- এমন রিপোর্টও ছাপা হয় প্রতি বছর খবরের কাগজগুলোতে। অন্যদিকে যেহেতু এই পরীক্ষার ফলাফলের ওপর বিদ্যালয়ের গ্রেডিং অনেকটা নির্ভর করে, সুতরাং কোনো কোনো বিদ্যালয় তুলনামূলকভাবে দুর্বল শিক্ষার্থীকে নানা উপায়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ থেকেও বিরত রাখতে পারে। এ বিষয়গুলো সংশ্লিষ্ট মহলের গুরুত্ব দিয়ে পর্যালোচনা করা উচিত। বিশেষত যারা অংশ নিতে পারে নি, তারা ঠিক কী কারণে অংশ নিতে পারে নি তা জানা থাকলে পরবর্তী সময়ের জন্য যথাযথ প্রস্তুতি নেয়া যাবে। পাশাপাশি যারা এবার অংশ নিতে পারে নি, তাদের সবাই যেন আগামীতে অংশ নিতে পারে, সে ব্যাপারেও জোরদার ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। না হলে দেখা যাবে, এদের বিপুল অংশ পড়ালেখা থেকে ঝরে পড়েছে। পড়ালেখায় একবার ছেদ পড়লে পুনরায় স্বাভাবিক স্রোতে ফিরে আসা অনেকের পক্ষেই দুরূহ, সুতরাং সেই বিষয়টির প্রতিও লক্ষ্য রাখা দরকার।
যারা ফেল করেছে তাদের জন্যও বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া দরকার। শোনা যাচ্ছে, জেএসসি/জেডিসি পরীক্ষায় যারা তিনটি বিষয়ে ফেল করেছে, তাদেরকে নবম শ্রেণীতে ভর্তির সুযোগ দেয়া হবে; তবে আগামী বছর পরীক্ষা দিয়ে তাদের পাশ করতে হবে। এটি অবশ্যই ভালো উদ্যোগ। গত বছরও এরকম উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। এখন একটু হিসাব-নিকাশ করে দেখা দরকার, গত বছর এ সুযোগটি কতো শতাংশ শিক্ষার্থী গ্রহণ করেছিল এবং তাদের কত শতাংশ এ বছর পাশ করেছে। যে কোনো ব্যাপারেই সঠিক হিসাব-নিকাশ বা পরিসংখ্যান থাকলে তা পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় উভয়েরই এ ব্যাপারে গুরুত্ব দেয়া উচিত। যারা তিনটির বেশি বিষয়ে ফেল করেছে তারা যেন পুনরায় নতুন বছরে একই শ্রেণীতে পড়তে পারে, সেটিও নিশ্চিত করা উচিত। স্বাভাবিক পড়ালেখা নিশ্চিত করা ছাড়াও তাদের প্রতি বিশেষ জোর দিয়ে আলাদা কর্মসূচি গ্রহণ করা দরকার।
এ লেখার উদ্দেশ্য এটা নয় যে, যারা কৃতকার্য হয়েছে তাদের ফলাফলকে প্রশ্নবিদ্ধ করা। বরং তাদেরকে অভিনন্দন জানিয়ে, তাদের ফলাফলকে আদর্শ ধরে আমাদের শিক্ষা যেন এগিয়ে যায়- সেটি নিশ্চিত করার জন্য কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করা এর উদ্দেশ্য। যে ভালো ফলাফল আমরা দেখছি, সেটি যেন সার্বিক মানদণ্ডে গুণগত শিক্ষারই প্রতিফলক হয়, সে ব্যাপারে নিঃসংশয় হওয়ার পাশাপাশি এরকম ফলাফল যেন আগামীতে অক্ষুণ্ন থাকে, সেই প্রত্যাশাও এ লেখার উদ্দেশ্য। যে প্রশ্নগুলো এখানে উত্থাপিত হলো, তার কোনোটিই নতুন নয়; বরং প্রতি বছর ফলাফল প্রকাশের পর এসব প্রশ্ন উঠে। কিন্তু সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে কোনো জবাব পাওয়া যায় না বা সংশয় নিরসনে আলাদা কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ে না। আশা করা যায়, সরকার এসব প্রশ্ন বা সংশয়ের ব্যাপারে অবগত এবং তাদের কাছে এগুলোর যথাযথ উত্তরও রয়েছে। দেশের শিক্ষার মান নিয়ে মানুষ আশ্বস্ত হতে চায়, এবং গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করার পাশাপাশি মানুষকে এ ব্যাপারে সংশয়মুক্ত করা সরকারেরই দায়িত্ব।