চট্টগ্রাম মীরেরসরাই দুর্ঘটনায় বাংলাদেশ আক্ষরিক অর্থেই থমকে গেছে। ঘটমান নানা খবরের প্রবাহে কিছুদিন পর হয়তো আমরা এর কথা ভুলে যাবো; শুধু যে পরিবারগুলোর সন্তান নিহত বা আহত হয়েছে তারা বছরের পর বছর এই শোকের ভার বইতে থাকবে। ঘটনার জন্য প্রত্যক্ষভাবে দায়ী চালককে খোঁজা হচ্ছে; হয়তো তার শাস্তিও হবে। কিন্তু এই দুর্ঘটনার কারণে ইতোমধ্যে যেসব প্রশ্ন উঠেছে, সেগুলোর কি কোনো সুরাহা হবে?
চালকের বদলে শিক্ষার্থীদের বহনকারী ট্রাকটি চালাচ্ছিলো চালকের সহকারী। গতি ছিল বেপরোয়া। কথা বলছিলো মোবাইল ফোনে। সহকারীকে দিয়ে গাড়ি চালানো, ব্যস্ত রাস্তায় গাড়ি-চালনা শেখা, জাল লাইসেন্স ব্যবহার করে চালক হওয়া, নির্ধারিত সীমার চেয়ে জোরে গাড়ি চালানো- এগুলো নিয়ে আসলে নতুন করে বলার কিছু নেই। দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। গাড়ি চালানোর সময় চালক মোবাইলে কথা বলছে- শুরুতে এরকম দৃশ্যে খটকা লাগলেও এখন তা সহনীয় আর দশটি ঘটনার মতোই। দৈবাৎ কখনো এসব কারণে জরিমানা করতে দেখলে তখন বরং অবাক-ই হই। এ যে স্বাভাবিকের ব্যতিক্রম!
তাই এসব প্রশ্ন পাশ কাটিয়ে দুর্ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে অন্য কিছু প্রশ্ন তুলতে চাই। এখন কতোটুকু চালু আছে জানি না, কিন্তু আমাদের সময়ে নানা ধরনের আন্তঃবিদ্যালয় প্রতিযোগিতা চালু ছিল। একেক সময় একেক বিদ্যালয়ে এসব প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হতো। আমরা দলবেধে সেই বিদ্যালয়ে খেলতে যেতাম, খেলা দেখতে যেতাম। যাওয়া-আসার এই কাজটি হতো সম্পূর্ণ নিজ উদ্যোগে। শিক্ষকরা কখনো এ নিয়ে মাথা ঘামিয়েছেন বলে মনে পড়ে না। তখন এতো যন্ত্রচালিত গাড়িও ছিল না, এতো বড় রাস্তাও ছিল না এবং চালকরা কিছুটা হলেও নিয়মকানুন মানতেন। সম্ভবত এ কারণেই আমরা বড় কোনো দুর্ঘটনার মুখোমুখি হই নি। যে চারটি বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা উপজেলা সদরে খেলা দেখতে গিয়েছিল, তারা সবাই বয়সে ছোট। তাদের এই খেলা দেখতে যাবার সাথে আমাদের ওই দলবেধে অন্য বিদ্যালয়ে খেলা দেখতে যাওয়ার মিল খুঁজে পাই। সেই সাথে দুর্ঘটনার পর এই মিলটাও সামনে চলে আসে- আমাদের মতোই এই শিক্ষার্থীদেরও যাওয়া-আসাটা ছিল নিজ উদ্যোগে। শিক্ষকরা এখানে মাথা ঘামান নি। কিন্তু মাথা ঘামানো কি উচিত ছিল না? বিদ্যালয়-পড়ুয়া ছোট শিক্ষার্থীরা যন্ত্রচালিত বাহনে ফেরত যাবে- সেখানে শিক্ষক বা আয়োজকদের দায় ছিল না শিক্ষার্থীদের দেখাশুনা করার?
আমাদের শিক্ষামন্ত্রী এ প্রসঙ্গে যে কথাটি বলেছেন তা এক অর্থে মানানসই। তিনি বলেছেন, একটি বিদ্যালয়ের মাত্র ৪/৫ জন শিক্ষকের পক্ষে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীকে দেখাশুনা করাটা সম্ভব হয়ে উঠে নি। বাস্তবতার নিরিখে আমি তাঁর বক্তব্যের সাথে একমত। সেই সাথে এই প্রশ্নও তুলতে চাই- শিক্ষার্থীরা যাতে ট্রাকে না উঠে বাস বা প্রচলিত কোনো বাহনে উঠে, সেটি দেখা কি শিক্ষকদের দায়িত্ব ছিল না? তাঁরা সেই দায়িত্ব পালন করেছেন? শিক্ষার্থীদের নিয়ে আয়োজিত প্রতিযোগিতায় আট কিলোমিটার দূরে যাতায়াতের দায়িত্ব অবুঝ শিক্ষার্থীদের কেন নিজেদেরকেই নিতে হবে? ট্রাক কি মানুষ যাতায়াতের মাধ্যম?
শিক্ষক শিক্ষার্থীদেরকে প্রচলিত কোনো বাহনে উঠিয়ে দিলেই যে দুর্ঘটনা হতো না, তা গ্যারান্টি দিয়ে বলা যায় না। তবে স্বান্ত্বনা থাকতো যে, প্রচলিত গাফিলতি একটু হলেও কম হয়েছে। আর শিক্ষামন্ত্রীর সাথে একমত হয়েও প্রশ্ন তুলতে চাই- শিক্ষার্থীদের ঠিকমতো আনা-নেওয়ার জন্য অন্য কোনো বিকল্পের কথা কি ভাবা হয়েছিল? শিক্ষক কম ঠিক আছে, সেক্ষেত্রে বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটি বা এসএমসির সদস্যদের সহায়তাও চাওয়া যেত। শিক্ষকরা যদি আগে থেকেই তাদের দায়িত্বের কথা মনে রাখতেন, তাহলে উপায় অবশ্যই বের করা যেত। পাঁচজন শিক্ষকসহ এসএমসির বারো জন সদস্য সচেষ্ট থাকলে এমন মর্মান্তিক দুর্ঘটনা এড়ানো যেত। খবরে এসেছে, আয়োজকদের পক্ষ থেকে অটোরিকশাসহ এই ট্রাকটিও ভাড়া করা হয়েছিল শিক্ষার্থীদের আনা-নেওয়ার জন্য। আয়োজকদের কতোটুকু কাণ্ডজ্ঞান থাকলে মানুষ আনা-নেওয়ার জন্য ট্রাক ভাড়া করতে পারে?
চট্টগ্রামের মীরসরাইয়ের দুর্ঘটনায় সবাই শোকাহত। শিক্ষকরা কাঁদছেন, অভিভাকরা সংজ্ঞাহীন, শিক্ষামন্ত্রী ছুটে গেছেন। অনেক কথা হচ্ছে, আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু নিয়ম না মানার বল্গাহীন প্রতিযোগিতা এবং দায়িত্ব সম্পাদনে যে সীমাহীন উদাসীনতা আমাদের মধ্যে রয়েছে- এই ব্যাপারে আমরা প্রত্যেকে নিজের জায়গা থেকে কি কিছু ভাবছি? আনুষ্ঠানিক শোক পালন গুরুত্বপূর্ণ; কিন্তু আমি মনে করি, আনুষ্ঠানিক শোক পালনের পাশাপাশি এই দুর্ঘটনা আমাদের নিয়ম মানা এবং দায়িত্ব পালনের প্রতি গুরুত্ব প্রদানের কথাই বেশি করে মনে করিয়ে দেয়। এই দুর্ঘটনা প্রমাণ করে দেয়, কী পরিমাণ গাফিলতি থাকলে এরকম একটা দুর্ঘটনা ঘটা সম্ভব। এখন দুর্ঘটনাটির কথা মাথায় রেখে কার কী দায়িত্ব সেই আলোচনাটি যদি আবার সচল হয়, শিক্ষকরা যদি পড়ালেখা করানোর পাশাপাশি তাদের অন্য দায়িত্বগুলোর কথা আবার ঝালাই করে নেন, রাস্তাঘাটে নিয়মকানুন মেনে চলার জন্য আমরা সবাই যদি সচেতন হই, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যদি তাদের কতর্ব্যকর্মে নিষ্ঠ থাকে, তাহলে এরকম দুর্ঘটনা অবশ্যই এড়ানো সম্ভব।