দেশের শিক্ষার ইতিহাসে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার ধারণাটি নতুন নয়। শতবর্ষ আগে থেকেই শিশুর সুষ্ঠু বিকাশের উপায় হিসেবে নানা ধরনের প্রচেষ্টা লক্ষ করা গেছে। এর মধ্যে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা অন্যতম। আমাদের ছেলেবেলায় শিশু শ্রেণী, ছোট ওয়ান, বেবি ক্লাস ইত্যাদি নানা নামে প্রথম শ্রেণীর আগেই অনানুষ্ঠানিকভাবে আরেকটি শ্রেণীর অস্তিত্ব ছিল, যা কালক্রমে প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। পার্থক্য হল, আগে এই শ্রেণীর জন্য শিক্ষাক্রম কিংবা পাঠ্যপুস্তকের বালাই ছিল না। অনির্ধারিতভাবে প্রথম শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তকের প্রথম কিছু অংশ কিংবা বাল্যশিক্ষা-জাতীয় বই পড়ানো হতো।
অবস্থা বদলেছে। সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণী অন্তর্ভুক্ত হবে। সেই মোতাবেক শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নসহ প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার প্রসারে বিস্তৃত কর্মপরিকল্পনাও গ্রহণ করা হয়েছে। প্রতিটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণী খোলা হয়েছে। শিক্ষার্থী ভর্তি শুরু হয়েছে। অন্যান্য শ্রেণীর মতোই প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক দেয়া হচ্ছে। সরকারের পাশাপাশি ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত কিন্ডারগার্টেন এবং বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও) কর্তৃক উপানুষ্ঠানিক প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়ও এ ধরনের শিক্ষা বিস্তারে কাজ করছে।
শিক্ষাক্রমের নিরিখে একেক দেশে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার ধরন একেক রকম। উন্নত দেশগুলোয় মনে করা হয়, এই শিক্ষা শিশুর সার্বিক বিকাশের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। তাই সেখানে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষায় আমাদের দেশের তুলনায় অনেক বেশি বিনিয়োগ করা হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, শৈশবে যারা প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা পায়নি, কৈশোর কিংবা যৌবনে তাদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার আশংকা সাত গুণ বেশি। সবার জন্য শিক্ষাসংক্রান্ত ইউনেস্কোর বার্ষিক প্রতিবেদন ২০১২ থেকে জানা যায়, বেশিরভাগ দেশেই (৭০ শতাংশ) প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় তিন বছর বয়স থেকে। এক-চতুর্থাংশ দেশে শুরু হয় চার বছর বয়স থেকে, পাঁচ শতাংশ দেশে পাঁচ বছর বয়সে এবং মাত্র এক শতাংশ দেশে ছয় বছর বয়সে। অপর দিকে, অর্ধেকসংখ্যক দেশে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার মেয়াদ তিন বছর, ৩১ শতাংশ দেশে দুই বছর, ছয় শতাংশ দেশে এক বছর এবং ১৩ শতাংশ দেশে চার বছর। শিশুদের প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা শুরুর বয়স এবং এ শিক্ষার মেয়াদ উভয়ের নিরিখেই বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে আছে এবং স্বল্পসংখ্যক দেশের কাতারে অবস্থান করছে। সরকারিভাবে আমাদের দেশে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা শুরুর বয়স পাঁচ এবং এর মেয়াদ মাত্র এক বছর। ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়ে অবশ্য দীর্ঘ মেয়াদের প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে, যা কেবল অল্পসংখ্যক শিশুর জন্য উন্মুক্ত।
একসময় আমাদের দেশে প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণীতে শিক্ষার্থী ভর্তির হার ছিল খুবই কম। গণসাক্ষরতা অভিযান পরিচালিত এডুকেশন ওয়াচের বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৯৮ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণীতে
ভর্তির হার ছিল মোটামুটি ১৫ শতাংশের মতো। বিশেষত তৃতীয় প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচিতে (পিইডিপি ৩) ব্যাপক উদ্যোগ নেয়ার ফলে ২০০৮ সালের পর এ হার বাড়তে থাকে। এডুকেশন ওয়াচের সর্বশেষ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১৩ সালে পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের ৫২.৫ শতাংশ প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষায় ভর্তি হয়েছিল। অবশ্য চার বছর বয়সী ২৯ শতাংশ শিশুকেও প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণীতে ভর্তি হতে দেখা গেছে। প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার মেয়াদ যা-ই হোক না কেন, এই উন্নতি অবশ্যই আশাব্যঞ্জক। আরও আশার কথা এই যে, ভর্তির হারের ক্ষেত্রে মেয়েরা ছেলেদের তুলনায় ৪.৬ শতাংশ এগিয়ে রয়েছে। অবশ্য গ্রামীণ এলাকার শিশুরা প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষায় ভর্তির দিক থেকে শহর এলাকার তুলনায় প্রায় ১৩ শতাংশ পিছিয়ে রয়েছে।
পিছিয়ে থাকার আরও কিছু অনুসঙ্গ রয়েছে। মা-বাবার শিক্ষা এবং পরিবারের আর্থিক অবস্থা এক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পড়ালেখা না জানা বা অল্প কিছু পড়ালেখা করেছেন এমন মা-বাবার চেয়ে বেশি পড়ালেখা জানা মা-বাবার ছেলেমেয়েদের মধ্যে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের হার বেশি। পরিবারের আর্থিক সামর্থ্য বাড়ার সঙ্গে প্রাক-প্রাথমিকে ভর্তির হার বাড়ারও একটি সুসম্পর্ক রয়েছে। আর একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সাধারণভাবে মা-বাবার শিক্ষার সঙ্গে তাদের আয়-রোজগারেরও ইতিবাচক সম্পর্ক রয়েছে। গবেষণায় এও দেখা গেছে, কম পড়ালেখা জানা ও আর্থিকভাবে দুর্বল মা-বাবার শিশুর প্রাক-প্রাথমিকে ভর্তির সম্ভাবনা ১৭ শতাংশ, যা বেশি পড়ালেখা জানা ও আর্থিকভাবে সামর্থবান মা-বাবার শিশুর ক্ষেত্রে ৭৬ শতাংশ। সুতরাং পরিবারের আর্থ-সামাজিক অবস্থার নিরিখে শিশুর প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষায় ভর্তির ক্ষেত্রে বৈষম্যের দিকটি সুস্পষ্ট।
প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষায় ভর্তির যে বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে, অর্থাৎ পাঁচ বছর, সেটিকে বিদ্যালয়ে যাওয়ার জন্য কম বয়স বলে মনে করেন অনেক মা-বাবা। অনেক মা-বাবা এত ছোট বয়সে শিশুদের বিদ্যালয়ে পাঠাতে অগ্রহী নন। এমনকি তাদের একটি বড় অংশ মনে করেন, বর্তমানে যেভাবে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা দেয়া হচ্ছে তার কোনো দরকার নেই। বাড়ির কাছাকাছি কোনো প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয় না থাকায় এবং এ শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে না জানার কারণে অনেক মা-বাবা তাদের সন্তানদের প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণীতে ভর্তি করান না।
প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষায় ভর্তির ক্ষেত্রে যদিও সাম্প্রতিক সময়ে অনেক অগ্রগতি দেখা গেছে, কিন্তু অনেক শিশু এখনও এ ধরনের শিক্ষার বাইরে। সামগ্রিকভাবে ৪-৫ বছর বয়সী শিশুদের প্রতি পাঁচজনে তিনজন প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার বাইরে রয়েছে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব মতে, বাংলাদেশে ৪-৫ বছর বয়সী শিশুর সংখ্যা ৬৫ লাখ। এই হিসাবে সারাদেশে পাঁচ বছর বয়সী ১৫ লাখ শিশু প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করছে না। চার বছর বয়সীদের যোগ করলে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৮ লাখে। সংখ্যাটি নেহায়েত কম নয়। প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষায় ভর্তির ক্ষেত্রে বিগত বছরগুলোর শ্লথ গতি পর্যবেক্ষণ করে সবার জন্য শিক্ষাসংক্রান্ত ইউনেস্কোর সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে প্রাক্কলন করা হয়েছিল, ২০১৫ সালের মধ্যে নিট ভর্তির হারের লক্ষ্যমাত্রা ৭০ শতাংশে উন্নীত করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্য ২৯টি দেশের মতো ‘অনেক বেশি পেছনে’ পড়ে থাকবে। এতে আরও বলা হয়েছিল, ওই সালের মধ্যে এ হার কোনোভাবেই ৩০ শতাংশ অতিক্রম করবে না। বাংলাদেশ যদি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এই ভর্তির হারের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে চায়, তবে দ্রুততার সঙ্গে অনেক পথ পাড়ি
দিতে হবে।
প্রশ্ন হল, এ পথ পাড়ি দেয়ার কোনো উপায় আছে কি? সরকারের পাশাপাশি নানা ধরনের কিন্ডারগার্টেন ও বেসরকারি বিদ্যালয়সহ প্রায় ১৫০টি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা প্রদান করছে। সরকারসহ এদের প্রত্যেকেরই যে মানসম্মত শিক্ষা প্রদানের সক্ষমতা রয়েছে তা বলা যায় না। সরকার ইতিমধ্যে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাসেবা প্রদানের যে মান নির্ধারণ করেছে, তার আলোকে প্রতিষ্ঠানগুলোয় একটি অনুসন্ধান কাজ পরিচালনা করতে হবে। এর মাধ্যমে মানসম্মত শিক্ষা প্রদানে সক্ষম প্রতিষ্ঠান বের হয়ে আসবে। এরপর কাজটি করতে হবে দুই ধাপে। প্রথম ধাপে সরকারের আর্থিক সহায়তায় মানসম্মত প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যাপক দায়িত্ব প্রদান করতে হবে। গুরুত্ব দিতে হবে সেসব প্রতিষ্ঠানকে, যেগুলো দ্রুত সারা দেশে গরিব শিশুদের মাঝে এই শিক্ষা ছড়িয়ে দিতে পারবে। প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আওতাধীন এলাকায় দুই বা তিনটি এক কক্ষবিশিষ্ট প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাকেন্দ্র খোলা যেতে পারে। এদের নিবিড় যোগাযোগ থাকবে সংশ্লিষ্ট প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সঙ্গে। দ্বিতীয় ধাপের শুরু হিসেবে একই সঙ্গে সরকারি প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বাড়ানোর ব্যাপক উদ্যোগ নিতে হবে। এর ফলে এক পর্যায়ে সরকারই প্রাক-প্রাথমিকের পুরো দায়িত্ব নিতে পারবে। নীতিগতভাবে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা প্রধানত রাষ্ট্রের দায়িত্ব হওয়া উচিত। বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নে সরকারের পক্ষ থেকে নেতৃত্বদানকারী কর্তৃপক্ষ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরকে এ ব্যাপারেও প্রধান ভূমিকা পালন করতে হবে। উপজেলা পর্যায়ে অধিদফতরের পক্ষ থেকে উপজেলা শিক্ষা অফিসগুলো ওই ধাপসমূহ বাস্তবায়নে মূল সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করতে পারে। যতক্ষণ সরকারের একার পক্ষে পুরো দায়িত্ব নেয়া সম্ভব হচ্ছে না, ততক্ষণ পর্যন্ত এ ব্যাপারে অন্য একাধিক অভিজ্ঞ প্রতিষ্ঠানকে উৎসাহ দেয়ার নীতি গ্রহণ করা যেতে পারে। উপর্যুক্ত ব্যবস্থা নেয়া গেলে ২০১৫ সালের মধ্যে না হলেও আগামী দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে অধিকতর সমতাসহ ভর্তির ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি ঘটানো অবশ্যই সম্ভব।
লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক যুগান্তর-এর উপসম্পাদকীয় বিভাগে যৌথভাবে ব্র্যাকের গবেষণা ও মূল্যায়ন বিভাগের প্রোগ্রাম হেড সমীর রঞ্জন নাথ-এর সাথে। মূল লেখার লিংক এখানে।