আমাদের প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক (বেতার ও টেলিভিশন) মিডিয়াগুলো নিজেদের গণমাধ্যম হিসেবে দাবি করলেও সত্যিকার অর্থে সেগুলোর কতোটুকু শুধু ‘মাধ্যম’ এবং কতোটুকু ‘গণ-মাধ্যম’ তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে। একটি মিডিয়া বা মাধ্যম মানুষের কিছু বিষয় নিয়ে কথা বললেই সেটি গণমাধ্যম হয়ে যায় না। গণমাধ্যম হতে হলে মিডিয়ার সঙ্গে মানুষের সরাসরি সম্পৃক্ততা থাকতে হয়; জনমানুষের নিজস্বতা, স্থানীয় ধ্যানধারণা ও সংস্কৃতি গণমাধ্যমের চরিত্রের মূল উপকরণ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে হয়। পণ্যের চেয়ে মানুষকেই সেখানে গুরুত্বপূর্ণ হতে হয়। চাপিয়ে দেয়া দর্শন, পণ্য বা তথ্য প্রচার করে; নাগরিক সমাজের স্ট্যান্ডার্ডকে সারাদেশের স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে বা অন্য সংস্কৃতিকে নিজ সংস্কৃতিতে জোরপূর্বক প্রবেশ ঘটিয়ে একটি মাধ্যম নিজেকে গণমাধ্যম বলে দাবি করতে পারে না– যদিও আমাদের গণমাধ্যমগুলোর ক্ষেত্রে মূলত তাই দেখা যাচ্ছে। দেশের প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াগুলো সাম্প্রতিক সময়ে তাদের কর্মকাণ্ডে মানুষের, বিশেষত নাগরিক সমাজের সম্পৃক্ততা বাড়িয়েছে; কিন্তু নিজেকে এখনো সেই পর্যায়ে উন্নীত করতে পারে নি– যে পর্যায়ে উন্নীত করলে নিজেকে সত্যিকার অর্থেই গণমাধ্যম হিসেবে দাবি করতে পারে। অতীতে বাংলাদেশ বেতারের এক ধরনের গণভূমিকা ছিল, কিন্তু এটিও আস্তে আস্তে সে অবস্থা থেকে সরে আসছে।
ব্লগ বা ব্লগিং আমাদের দেশে নতুন। শুধু আমাদের দেশেই না, বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিতেও ব্লগ সংস্কৃতি এসেছে খুব বেশিদিন আগে নয়; কিন্তু এরই মাঝে এটি মিডিয়াজগতে কিছুটা আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। একটা সময় পর্যন্ত ব্লগের ধারণা শুধু ব্যক্তিমানুষের লিখিত অনলাইন ডায়েরির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও আস্তে আস্তে এতে বহুমাত্রা যুক্ত হয়েছে। আজ থেকে বছর পাঁচেক আগেও অনেকে ব্লগের কথা জানতেন না। যারা ব্লগ লিখতেন, তাদের অধিকাংশ মূলত নিজেদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বা পর্যবেক্ষণ ওয়েবে লিপিবদ্ধ করে রাখতেন। সে অবস্থা থেকে ব্লগ এখন এমন পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে যেখানে ব্লগকে একটি আলাদা মিডিয়ার মর্যাদা দেয়া যায় কিনা, তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। পাশাপাশি ব্লগ মানুষের মত প্রকাশের অন্যতম একটি হাতিয়ার হিসেবেও দিন দিন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। মত প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে প্রচলিত ‘গণমাধ্যম’গুলোর সীমাবদ্ধতা হচ্ছে– এগুলো মোটামুটি একরতফা বা একপাক্ষিক। সেখানে পাঠকের দিক থেকে লেখক বা বক্তার সঙ্গে সরাসরি মিথস্ক্রিয়ার সুযোগ খুবই কম। কিন্তু ব্লগে লেখকের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করা যায়, বক্তব্য পছন্দ বা অপছন্দ হলে তা সরাসরি বলা যায়। এমনকি লেখক ভুল তথ্য দিলে বা লেখায় অসততা থাকলে পাঠক সেখানে প্রতিবাদও জানাতে পারে। প্রিন্ট বা ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় লেখক-পাঠক মিথস্ক্রিয়ার এ চরিত্রটি মোটামুটি অনুপস্থিত। যে দুয়েকটি সীমিত ক্ষেত্রে পাঠক বা দর্শককে সরাসরি যুক্ত করার চেষ্টা করা হয়, সেখানেও মিথস্ক্রিয়ার সুযোগ ও সময় থাকে তুলনামূলকভাবে কম। আজকাল অবশ্য সংবাদমাধ্যমগুলোর কিছু কিছু তাদের ওয়েব সংস্করণে পাঠকের প্রতিক্রিয়া জানার ব্যবস্থা যুক্ত করেছে, কিন্তু সেটিও আসলে একতরফা যোগাযোগ। পাঠকের মতামতের ওপর ভিত্তি করে লেখকের প্রতিক্রিয়া জানা যায় না, এমনকি ভুল তথ্য থাকলে লেখকের সেটি সংশোধনের সুযোগ নেই। ব্লগ এ সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত।
ব্লগ একসময় ব্যক্তিকেন্দ্রিক লেখালেখির ক্ষেত্র থাকলেও আস্তে আস্তে বেশ কিছু ব্লগ-প্ল্যাটফর্ম তৈরি হতে থাকে। এসবের কোথাও কোথাও মডারেশন রয়েছে, কোনোটি বা উন্মুক্ত। ব্যক্তিকেন্দ্রিক লেখার বাইরেও ব্লগের যে বৈশিষ্ট্যটি দিন দিন সমাজবিজ্ঞানীদের কাজের ক্ষেত্র হয়ে দাড়াচ্ছে, সেটি হচ্ছে এর সংবাদ প্রদানের ক্ষমতার বিশেষ বৈশিষ্ট্যটি। যারা ব্লগ লিখেন, অর্থাৎ ব্লগাররা প্রথাগত অর্থে সাংবাদিক নন (যদিও অনেক সাংবাদিক ব্লগ লিখেন); কিন্তু ব্লগের মাধ্যমেই অনেক তাৎক্ষণিক খবর পাওয়া যায়। সংবাদ মাধ্যমের আগে এখন ব্লগেই খবর আগে পাওয়া যায়। বাংলাদেশে বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনা অনেকে জেনেছেন ব্লগের মাধ্যমেই। ব্লগাররা ঘটনা ঘটামাত্র ব্লগে লিখে ফেলতে পারেন। প্রিন্ট বা ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় খবর প্রকাশে যেসব পদ্ধতিগত দিক, সময় বা উপস্থাপনার বিষয় মাথায় রাখতে হয়, ব্লগে তার দরকার পড়ে না। ভাষার কারুকাজের চেয়ে ব্যক্তির তথ্য প্রদানের দ্রুততা এবং নিজস্ব পর্যবেক্ষণ সেখানে গুরুত্বপূর্ণ। ঘটনা ঘটামাত্রই তথ্য ছড়িয়ে দেয়ার যে ক্ষমতা ব্লগের রয়েছে, ‘মুহূর্তেই সব সংবাদ’-জাতীয় শ্লোগানের দাবিদার তথ্যমাধ্যমেরও সেই ক্ষমতা নেই।
ব্লগের কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে– সেগুলো পদ্ধতিগত নাকি ব্লগের চরিত্র নির্ধারণ না হওয়ার কারণে সৃষ্ট তা অন্য বিতর্কের বিষয়। এর সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা দায়বদ্ধতায়। প্রিন্ট বা ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রকাশিত সংবাদে যে আপাত-দায়বদ্ধতা দেখা যায়, ব্লগের সেটি অনেকটা অনুপস্থিত। বিশ্বে অনেকেই নিষ্ঠা ও দায়বদ্ধতার সাথে ব্লগিং করে যাচ্ছেন, অনেক জনপ্রিয় সংবাদপত্রের চেয়ে তাদের প্রকাশিত তথ্য বা লেখার জনপ্রিয়তা কম নয়– কিন্তু সেগুলো বিচ্ছিন্ন উদাহরণ। দায়বদ্ধতার ক্ষেত্রে ব্লগ এখনো নিজের অবস্থান পোক্ত করতে পারে নি। ফলে ব্লগ থেকে পাওয়া খবর অনেকে প্রথমে বিশ্বাস করতে চান না; খবরের সত্যতা যাচাই করতে চান। সন্দেহ নেই, অনেক ব্লগার কিছুটা বাড়িয়ে লিখেন, অনেক তথ্য ঠিকমতো উপস্থাপিত না হওয়ায় বিশ্বাসযোগ্যতা হারায়, গুজবও রটে ব্লগ থেকে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, ব্লগে ভুল বা অসত্য তথ্য উপস্থাপন করে পার পাওয়া দিন দিন কঠিন হয়ে যাচ্ছে। ব্লগের দায়িত্বশীলতাও বাড়ছে দিন দিন। এ কারণেই তথ্য ও গণমাধ্যমে ব্লগ ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। যাত্রা শুরুর সময় উইকপিডিয়ার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে অনেকে প্রশ্ন উঠেছিল, কিন্তু উইকিপিডিয়ার দায়িত্বশীল আচরণে আজকে এটি অনেকের কাছেই গ্রহণযোগ্য। ব্লগও সে অবস্থানে যাচ্ছে দিন দিন।
লেখাটির শিরোনামে ‘বিকল্প’ ও ‘গণমাধ্যম’ শব্দদুটো ব্যবহার করা হয়েছে ইচ্ছাকৃতভাবে। প্রশ্ন উঠতে পারে, বিকল্প কেন, মূল গণমাধ্যম নয় কেন? এছাড়া ব্লগকে শুধু ‘মাধ্যম’ না বলে ‘গণমাধ্যম’-ই বা কেন বলা হচ্ছে?
আমাদের পরিচিত মাধ্যমগুলো কোনো না কোনোভাবে প্রাতিষ্ঠানিকতার চর্চা করছে। এগুলোর প্রতিষ্ঠা, পরিচালন বা অগ্রগতি-প্রক্রিয়া– সবকিছুর সঙ্গেই কোনো না কোনোভাবে প্রাতিষ্ঠানিকতা জড়িত এবং এর সবকিছুই কাজ করে নির্ধারিত কাঠামোর মধ্যে। মূলধারার মাধ্যম হতে হলে এর ব্যত্যয় নেই। অপরদিকে ব্লগের চরিত্র মূলত বৈশ্বিক। মূল মাধ্যমগুলোতে কারা লিখবেন ও কী লিখবেন, তাও নিয়ন্ত্রিত হয় একটি কাঠামোর মধ্য থেকেই। লেখক সেই কাঠামো ভাঙতে পারেন না। অপরদিকে ব্লগলেখকদের ভৌগলিক সীমানা নেই, নেই এই কাঠামোগত বাধ্যবাধকতা। নানা দেশ থেকে, ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে অবস্থান করে তারা লিখছেন। মূল সংবাদমাধ্যমগুলোতে নামিদামি লেখকরা গুরুত্ব পায় বেশি। সেখানে তারকালেখকদের আলাদা মূল্য দেওয়া হয়। ব্লগে ঠিক সেরকমটি দেখা যায় না। অবশ্যই ব্লগে তারকালেখক রয়েছেন কিন্তু তাদেরকে ‘তারকা’ হতে হয়েছে ব্লগ-পাঠকদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে, নিজের লেখার গুণে। তারা মিডিয়াসৃষ্ট নন। অনেক মিডিয়া-তারকা ব্লগে লেখালেখি শুরু করলেও টিকতে পারেন নি এসব কারণেই। একটি মূল মিডিয়া হওয়ার জন্য যেসব চরিত্র থাকা দরকার, ব্লগ সেগুলোর বিকল্প চরিত্র ধারণ করে বলেই ব্লগকে বিকল্প মাধ্যম হিসেবে বলা হচ্ছে।
‘গণমাধ্যম’-এর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। বহুল ব্যবহারে গণমাধ্যম শব্দটির ভিন্নার্থ দাড়িয়ে যাচ্ছে; কিন্তু জনমানুষের মিথস্ক্রিয়া এবং মাধ্যমের যাবতীয় কাজকর্মে জনমানুষের সম্পৃক্ততা ছাড়া কোনো মিডিয়া নিজেকে গণমাধ্যম বলে দাবি করতে পারে না। ব্লগ এখন পর্যন্ত যে চরিত্র ধারণ করেছে, তাতে তার প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে নিজেকে গণমাধ্যম হিসেবে বিকশিত ও প্রতিষ্ঠা করার– যেখানে সত্যিকার অর্থেই মানুষ নিজেদের বিষয় নিয়ে কথা বলবে। নিজের কথা অপরের মুখ দিয়ে বলানোর চেয়ে নিজের কথা বলবে নিজেই। নিজেদের চিন্তাভাবনা অন্যের সঙ্গে নিজেই শেয়ার করবে এবং পরস্পরের যুক্তিতর্কগুলো উঠে আসবে সরাসরি। ব্যক্তির নিজস্ব চিন্তাভাবনা পণ্যের প্রভাবে প্রভাবিত না হয়ে নিজস্ব প্রয়োজনে আবর্তিত হবে। একটি কার্যকর বিকল্প গণমাধ্যম হওয়ার জন্য ব্লগমাধ্যমকে আপাতত পাড়ি দিতে হবে মাত্র দুটো পথ– ব্লগারদের নিজেদের বক্তব্যের প্রতি আরো দায়িত্বশীল হওয়া এবং ইন্টারনেট ব্যবস্থার প্রসার। বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহার সহজলভ্য না হওয়ায় ব্লগ এখনো শহুরে নাগরিক সমাজের নাগালের বাইরে যেতে পারে নি। এ সীমাবদ্ধতাটুকু কাটিয়ে উঠতে পারলে একটি কার্যকর বিকল্প গণমাধ্যম হওয়ার সব সম্ভাবনাই রয়েছে ব্লগের মধ্যে।