চলমান এসএসসি পরীক্ষায় বিভিন্ন বোর্ডে বিভিন্ন বিষয়ের প্রশ্নপত্রে যেসব ভুলের খবর জানা গেছে একটি দৈনিক পত্রিকা থেকে, তাতে প্রথমেই যে প্রশ্নটি মনে জাগে – এসব প্রশ্নপত্র তৈরির সাথে যারা জড়িত ছিলেন, তাঁরা তাঁদের কাজে কতোটুকু দক্ষ ও আন্তরিক ছিলেন?
আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা পরীক্ষাকেন্দ্রিক। পড়ালেখা যা-ই হোক না কেন, পরীক্ষা হচ্ছে ঠিকঠাক সময়ে। পাবলিক পরীক্ষাগুলো ঠিক সময়ে যথাযথভাবে সম্পন্ন করা ও নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ফলাফল প্রকাশ করা – এ জায়গাটিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সত্যিকার অর্থে দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছে। তবে, দিনে দিনে এ বোধও জন্মাচ্ছে যে, আমাদের ছাত্রছাত্রীদের (এবং তাদের অভিভাবকদের) সমস্ত চিন্তাভাবনা এখন পরীক্ষার দিকে। শিক্ষকরা যখন পড়ান, তখন তাঁদেরও মনোযোগ থাকে পরীক্ষার দিকেই। সিলেবাস তো শেষ করতে হবে! শুনেছি, একেকটি বোর্ডের সাফল্য এখন নির্ধারিত হয় ওই বোর্ডের পাশের হার, সিজিপিএ পাওয়ার হার ইত্যাদি দিয়ে।
পড়ালেখায় পরীক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার; কিন্তু এরকম গুরুত্বপূর্ণ আরও অনেক বিষয় আছে। সেগুলোতে আমরা হালকা-পাতলা চোখ বুলিয়ে টর্চের সমস্ত আলো ফেলছি কেবল পরীক্ষার ওপর।
আগের বছরগুলো গেল প্রশ্নপত্র ফাঁসের টালমাতাল অবস্থায়। এ-দিক থেকে এবার অবস্থা ভালো। বলা যায়, সাফল্য এসেছে। যদিও রুটিন কাজকে সাফল্য বলা যায় কি-না, এ নিয়ে নানা বিতর্ক রয়েছে; কিন্তু প্রশ্নপত্র ফাঁসের যে অব্যাহত প্রক্রিয়ার মধ্যে ছিলাম, সেখান থেকে বেরিয়ে আসায় স্বস্তি এসেছে অনেকখানি। সংশ্লিষ্টরা এজন্য ধন্যবাদ পাবেন। কিন্তু, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা সম্ভবত ওই গরীবের মতো! পিঠের অংশ ঢাকতে গিয়ে পেটের কাপড় বেরিয়ে পড়ে।
অনেকেরই হয়তো জানা আছে, আমাদের একেকটি শিক্ষাস্তরে, যেমন, প্রাথমিক বা মাধ্যমিকে যে পরিমাণ শিক্ষার্থী আছে, সেই পরিমাণ জনসংখ্যা অনেক দেশের নেই। ফলে পাবলিক পরীক্ষার মতো বিশাল কর্মযজ্ঞ সুচারুভাবে সামলানো কম কষ্টের কাজ নয়! এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন দুটো বিষয়ের – এক, দক্ষতার ও দুই, আন্তরিকতার। একটির ঘাটতি থাকলেই বিপর্যয় ঘটতে বাধ্য।
প্রশ্নপত্রে ভুলের বিষয়টিতে সম্ভবত দুটোরই ‘অবদান’ আছে। যশোর বোর্ডে গণিতের প্রশ্নপত্রে ১১টি ভুল পাওয়া গেছে। চট্টগ্রাম বোর্ডের বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যম দুটো মিলিয়ে গণিতের প্রশ্নপত্রে ১১টি ভুল পাওয়া গেছে। ঢাকা বোর্ডের পদার্থবিজ্ঞানের প্রশ্নপত্রে পাঁচটি ভুল এবং রাজশাহী বোর্ডের বাংলা প্রথম পত্রের প্রশ্নপত্রে তিনটি ও দ্বিতীয়টিতে চারটি ভুল পাওয়া গেছে।
ভুল হতেই পারে – এই আপ্তবাক্য স্বীকার করে নেয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ। কিন্তু কোন পর্যন্ত? এর কি সীমা থাকা প্রয়োজন? এতোগুলো ভুল দেখে কি মনে হচ্ছে না যে, এগুলো নিছকই ভুল নয়; বরং স্রেফ মশকরা! কিছু নির্দিষ্ট মানুষকে প্রশ্নপত্র তৈরি করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তাঁরা নিশ্চয়ই এসব কাজে অভিজ্ঞ ও দক্ষ; না হলে তো এ-কাজে সুযোগ পেতেন না। যদি তাই হয়, তাহলে তাঁরা কি তাঁদের দক্ষতার প্রয়োগ ঘটাতে চেয়েছিলেন প্রশ্নপত্র তৈরির সময়? নাকি যেনতেনভাবে একটা কিছু তৈরি করে দায়িত্ব সেরেছেন? তাঁরা যদি দক্ষই হন, আন্তরিকই হন, তাহলে ধরে নিতে হবে প্রশ্নপত্র তৈরির ক্ষেত্রে তাঁরা মোটেই দক্ষতা ও আন্তরিকতার পরিচয় দিতে পারেননি। নিজেদেরকে অন্যায়কারী হিসেবে প্রমাণ করা ছাড়া এক্ষেত্রে আর কোনো দক্ষতা তাঁরা দেখাতে পারেননি।
(সম্ভবত) এর চেয়েও ‘করুণ মজার’ ঘটনা ঘটেছে ঢাকা, গাজীপুর, পটুয়াখালী, নীলফামারী, গোপালগঞ্জ ও যশোরের কিছু পরীক্ষাকেন্দ্রে। সেখানে শিক্ষকরা পরীক্ষা নিয়েছেন ২০১৪ সালের প্রশ্নপত্রে। দু’বছর আগের প্রশ্নপত্র কীভাবে সেখানে গেল সেটি এক রহস্য। পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র কীভাবে তৈরি, সরবরাহ ও বিলি হবে তার একটা নির্দিষ্ট নিয়ম আছে। প্রতিটি ধাপে দায়িত্বশীল একাধিক ব্যক্তি জড়িত থাকেন। পরীক্ষাকেন্দ্রের কক্ষ পরিদর্শক বা এই স্তরের শিক্ষকদের পক্ষে তো এসব প্রশ্নপত্র তৈরি বা বিলি করা সম্ভব না, যদিও তাদের অনেকেই শাস্তি পেয়েছেন। ২০১৪ সালের প্রশ্নপত্র বিলি হয়েছে কাদের উদ্যোগে, গলদটা শুরু হয়েছে কোথায় তা বের করতে পারলে হয়তো একটা ইন্টারেস্টিং গল্প জানা যেতে পারে। মূল ঘটনাটি কি জানা যাবে আদৌ?
এসব কাজে কতোটুকু দক্ষতার প্রয়োজন হয়? প্রয়োজন কতোটুকু আন্তরিকতার? খুব কি বেশি? যারা প্রশ্ন তৈরি করেন, তাঁরা তো সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞ। তাঁরা কি যেনতেনভাবে ভুল প্রশ্ন তৈরি করে জমা দেন রিভিউ, সম্পাদনা ও পরবর্তী অনুমোদনের জন্য? যারা প্রাথমিকভাবে তৈরিকৃত প্রশ্নপত্র পরে ঠিকঠাক করেন, তারা কি উক্ত প্রশ্নপত্রের ভুল ধরতে অক্ষম? উত্তরগুলো হ্যাঁ হলে তাঁদের দক্ষতা ও যোগ্যতার অভাবেরই প্রমাণ মেলে। আর না হলে বলতে হবে তাঁরা যেনতেনভাবে প্রশ্নপত্র তৈরি করে দিয়েছেন পরীক্ষার জন্য। বলতে হবে, মনোযোগ দিয়ে সুচারুরূপে প্রশ্নপত্র তৈরির মানসিকতা তাঁদের ছিল না।
এ-ধরনের কাণ্ড যে এই প্রথম ঘটলো তা নয়। এর আগেও, গত বছর, নোয়াখালীর একটি উপজেলার একটি কেন্দ্রে পৌরনীতি ও সুশাসন প্রথম পত্রের পরীক্ষায় দ্বিতীয় পত্রের প্রশ্ন দেওয়া হয়েছিল। পরীক্ষা নিয়ে সম্ভবত একটু খামখেয়ালীপনাই দেখিয়েছিলেন সংশ্লিষ্টরা।
কিন্তু এসবের ফল যাদের ভোগ করতে হচ্ছে, সেই শিক্ষার্থীদের কীভাবে ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে? পরীক্ষার হলে তারা যখন ভুল প্রশ্ন দেখে, তখন এসব ভুল প্রশ্নের কী উত্তর দিবে, আদৌ লিখবে কি-না, এরকম অনেকে দোটানায় ভুগতে হয় তাদের। বাড়তি মানসিক চাপের ব্যাপার তো রয়েছেই। পরীক্ষার হলের টেনশন ও বাড়তি চাপ ইত্যাদি মিলে অনেক শিক্ষার্থী স্বাভাবিক পরীক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়। কক্ষ পরিদর্শকরাও এ-সময় তড়িৎ সিদ্ধান্ত স্বাভাবিক কারণেই দিতে পারেন না। ফলে সময় নষ্ট হয় শিক্ষার্থীদের, তার পরীক্ষার গোটা পরিকল্পনাটাই হয়ে যায় উল্টাপাল্টা।
শিক্ষার্থীদের ক্ষতিপূরণের ব্যাপারে প্রচলিত অদ্ভুত সমাধানটিই বেছে নিয়েছেন কর্তাব্যক্তিরা। চট্টগ্রাম বোর্ড কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, বহুনির্বাচনী ভুল প্রশ্নগুলোর নম্বর সবাইকে দেওয়া হবে আর সৃজনশীল প্রশ্নগুলোতে যারা উত্তর লেখার চেষ্টা করেছে, তাদের নম্বর দেওয়া হবে। বাহ! এর চেয়ে তো সবাইকে গড়ে একটা নির্দিষ্ট নম্বর দিয়ে দেওয়াটাই ভালো। পরীক্ষার আর কী দরকার?
পরীক্ষা কেন নেওয়া হয় – এ প্রশ্নের উত্তর সবার জানা। নতুন করে ব্যাখ্যা প্রদান অনাবশ্যক। যে প্রশ্নগুলোতে ভুল আছে, সেগুলোর নম্বর যদি সবাইকে দিয়েই দেওয়া হয়, তাহলে পরীক্ষারই প্রয়োজন পড়ে না। ৪০টি প্রশ্নের মধ্যে ১১টি ভুল থাকলে সবাইকে এই ১১ নম্বর (মানে ২৭ শতাংশ) দিয়ে দিলে পাশ করার জন্য খুব বেশি খাটাখাটনি করার প্রয়োজন পড়বে না শিক্ষার্থীদের। বরং যারা পড়ালেখায় একটু পিছিয়ে পড়া, সেসব শিক্ষার্থী যদি প্রতিবছর প্রশ্নপত্রে এ-ধরনের ভুল হওয়ার আশা নিয়ে বসে থাকে, তাহলে তাদের মোটেই দোষ দেয়া যাবে না। ক্ষতিটা হবে যারা সত্যিকার অর্থে পড়ালেখা করেছে তাদের। এ ধরনের দুয়েকটি ঘটনাই পড়ালেখার প্রতি শিক্ষার্থীদের প্রেরণা ও প্রণোদনা হারানোর জন্য যথেষ্ট।
এ-ধরনের ঘটনার অবশ্য সুবিধাও আছে কিছু। যেহেতু ভুল হওয়া প্রশ্নগুলোর ক্ষেত্রে সবাইকে নম্বর দিয়ে দেওয়া হবে, সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষার্থীদের নম্বর যাবে বেড়ে। আর নম্বর বাড়লে তো পাশের হার, জিপিএ-র ইত্যাদিও বেড়ে যাবে অটোমেটিকভাবে। ‘সাফল্য’ও বাড়বে। ক্ষতি কী!
তবে এটি যেহেতু একটি সমস্যা, সুতরাং এ থেকে উত্তরণের উপায় বের করা প্রয়োজন। আবার উপায় বের করার আগে প্রথমে নির্ধারণ করা দরকার এখানে কোনটি মূল সমস্যা। প্রশ্নপত্রে ভুল এড়ানোর বিষয়টি মূখ্য হলে এর আলাদা কোনো সমাধান নেই। যার যার কাজ ঠিকমতো করলে এরকম হওয়া সম্ভব নয়। ইচ্ছাকৃত সমস্যার সমাধান হয় না।
অপরদিকে ভুল হওয়া প্রশ্নপত্রে শিক্ষার্থীদের ক্ষতিগ্রস্ত না করে কীভাবে তাদের নম্বর দেয়া যায় – এরও কোনো উত্তর থাকা উচিত না। কারণ ভুল সিস্টেম থেকে সঠিক ফলাফল বের করা যায় না।
যারা এসব কাজের সঙ্গে সম্পর্কিত, তাঁরা তাদের দক্ষতা ও আন্তরিকতা যাতে বাধ্য হয়ে হলেও প্রয়োগ করেন – সেটুকু নিশ্চিত করার কৌশলটাই শুধু বের করাটা প্রয়োজন, দ্রুত।