থাকি ঢাকার বাইরে। আগে মতো আর প্রতিদিন বইমেলায় যাওয়া হবে না। এ এক বড় দুঃখ!
১৯৯৩ সাল, নবম শ্রেণীতে উঠেছি। পিসিরা খ্যাপায়- নাইনে নাকি ‘লাইন’ করে। শুনে কিছুটা লাজরাঙা হই; কৈশোর বয়স। দাড়িগোফ উঠতে শুরু করেছে। আভাস দিচ্ছে বড় হওয়ার কিংবা বড়ত্বের। পিসিদের কথার প্রবল প্রতিবাদ করি- না, না, লাইন-টাইন করবো না। তাহলে কী করবি?- পিসিদের প্রশ্নের উত্তরে বলি, কবিতা লিখবো। ইতোমধ্যে বেশ কিছু ছড়া লিখেছি, আস্তে আস্তে ভাবছিলাম কবিতার দিকে যাবো কিনা। কবিতা আমার কাছে তখনো বড়দের ব্যাপার। ভেবেছিলাম লাইনের বদলে পিসিদের কবিতার দিকে ডাইভার্ট করা যাবে; কিন্তু শুনে তারা বললো- মানুষ নাকি প্রেমে পড়লে কবিতা লিখে!
তাই কি?
বাড়ি মোহনগঞ্জে। ওটা নেত্রকোনায়। মোহনগঞ্জে শহীদ মিনারের পাশে একটা পাঠাগার আছে। মোহনগঞ্জ সাধারণ পাঠাগার। আমার শৈশব-কৈশোরের অন্যতম প্রিয় স্থান। পিসিদের কথা শুনে বেশ কিছু কবিতার বই পড়লাম পাঠাগারে- ব্যাপারটা আসলেই তাই। অধিকাংশ কবিতাই ‘তোমাকে’ নিয়ে। গ্রন্থাগারিককে বললাম, রাজনীতি বা সমাজ ইত্যাদি নিয়ে কবিতা নেই? তিনি কিছু বই ধরিয়ে দিলেন- পরিচিত হলাম অনেক স্বাদের নতুন নতুন কবিতার সাথে। নির্মলেন্দু গুণের ‘হুলিয়া’র সাথে প্রথম পরিচয় সম্ভবত তখনই। পাঠ্যবইয়ের বাইরে যে আরও অনেক নানা ধরনের দারুণ দারুণ কবিতা থাকতে পারে, সেই প্রথম পরিচয়- মানুষের এই ভিন্নতর মোহনভঙ্গীটির সাথে।
বাবা নানা কাজে ঢাকায় আসে। প্রায়ই। এরকমই একটি দিনে জানা গেল- দুদিন পরই বাবা ঢাকা যাবে। আবদার জানালাম- ঢাকায় নাকি বইমেলা হচ্ছে। আমার জন্য বই আনতে হবে। বাবা বলে, কী বই? উত্তর দিতে পারি না। সুনির্দিষ্ট কোনো বইয়ের নাম তো বলা হয় না, কারণ ওগুলো মোহনগঞ্জ সাধারণ পাঠাগারে আছেই। তাহলে কী বলবো? বলি, যা হোক, একটা পছন্দ করে এনো। আর সাথে একটা কবিতার বই।
বাবা বই আনে নি। বইমেলায় যাবার সময় হয় নি। অবাক হয়ে ভাবি- বইমেলা হচ্ছে, আর একটা মানুষ কী করে বইমেলায় যাওয়ার সময় পায় না! তখন সম্ভবত ভোরের কাগজ কিংবা আজকের কাগজে মাঝেমাঝে বইমেলা নিয়ে খবর ছাপা হয়। সেগুলো পড়ি। বাবার কলেজের শিক্ষকরা মাঝে মাঝে ঢাকায় আসেন, তাঁরা বড়রা আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে বইমেলা নিয়ে আলোচনা করেন। আমি শুনি। শুনতে শুনতে বইমেলা সম্পর্কে আরেকটু আগ্রহ হয়। শোনা কথায় বইমেলাকে জানা তাই শুরু ১৯৯৩ সাল থেকে।
১৯৯৫ সালের শেষদিকে ঢাকায় আসি- উচ্চশিক্ষার্থে। তিতুমীর কলেজে ভর্তি হই। প্রথম বছর, ১৯৯৬ সালের শুরুতে, ঢাকার চাকচিক্য দেখে ভুলে যাই বইয়ের মেলার কথা। তাছাড়া আর্থিক সংকট ছিল, মাসে ১০০০-১২০০ টাকা দিয়ে চলতে হতো, এর মধ্যে ৫০০ টাকা মেসভাড়া। মহাখালী ওয়্যারলেস গেট থেকে ছয় নম্বর বাসে ফার্মগেট যাই আটআনা দিয়ে। বেরুবার সময় পকেটে নিই মাত্র দুই টাকা। এক টাকায় যাওয়া-আসা, আরেক টাকা বিপদের সহায় হিসেবে। বই তাই আর মাথায় আসে না। ১৯৯৭ সালটাও কাটলো এভাবেই- সামনে এইচএসসি- সুতরাং বইমেলা বাদ।
এরপর বোধহয় কোনোবছর বইমেলা বাদ যায় নি। ১৯৯৯ সাল থেকে তো রীতিমতো বইমেলার স্টলে বসি- বই বিক্রি করি- ‘শিক্ষাবার্তা’র স্টলে। আমি আর জগন্নাথ হলের অশোকদা। স্টল দিয়েছেন ‘শিক্ষাবার্তা’র সম্পাদক ও নটর ডেম কলেজের শিক্ষক এ. এন. রাশেদা আপা। বছর চারেক আমি আর আশোকদা- দুজন মিলে বইমেলায় শিক্ষাবার্তার স্টল সামলেছি। মূল আকর্ষণ নতুন নতুন বই পড়া। অশোকদা ছাড় দিতেন- তিনি বই বিক্রি করতেন, আমি বসে বসে নতুন বই পড়তাম, যেহেতু কেনার সামর্থ্য ছিল না। চার বছরে কতোগুলো নতুন বই যে পড়েছি, তার ইয়ত্তা নেই- এখনও তাই ঋণী হয়ে আছি ‘শিক্ষাবার্তা’র কাছে। সারা মাস স্টলে বসার পর রাশেদা আপা কিছু টাকা ধরিয়ে দিতেন, আমি আর অশোকদা শেষমেষ কাঁচুমাচু হয়ে বলতাম- আপা, অনেক বই তো বিক্রি হয় নাই, কিছু বই নিই? তিনি হেঁসে বলতেন, নাও, নিয়ে যাও। মেলার শেষ দিন দুজন মিলে ছয়-সাত হাজার টাকার বই মাথায় করে নিয়ে আসতাম, হলে।
বইমেলায় গতবছরও গিয়েছি- প্রায় প্রতিদিনই। গিয়ে কী করি? কিছুই না, আড্ডা দিই। বই দেখি। বড় কথা- আরাম লাগে ওখানে গেলে। না গেলে ছটফট লাগে। এই জানুয়ারি মাসের পাঁচ তারিখে চলে গেলাম রাজশাহীতে, পাকাপাকিভাবে, সুতরাং ১৯৯৩ সালের মতো এখন থেকে আমার বইমেলাগুলো কাটবে শোনা কথায়। শোনা কথায় বইমেলা খুব কষ্টের! চেষ্টা থাকবে ফেব্রুয়ারি মাসের ছুটির দিনগুলোতে ঢাকায় থাকার- যতোটা সম্ভব! একটা মাসই তো!
আজ, ফেব্রুয়ারির ১ তারিখে, এ বছরের বইমেলা উদ্বোধন হলো। গতকাল রাতে ঢাকায় চলে এলাম। সারাদিন বিশ্রাম নিয়ে বিকেলবেলায় গেলাম বইমেলায়। বউসহ। ছুটির দিন বলে প্রচুর মানুষ। প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে উদ্বোধন করে চলে গেছেন। সুতরাং নির্বিঘ্নেই ঢুকা গেল। দুজন মিলে ঘুরছি। আমার সম্পাদনায় একটি বই বের হবার কথা- ‘শুদ্ধস্বর’ থেকে- ওখানে গিয়ে দেখলাম বই আসে নি। অন্য স্টলগুলো একটু একটু করে চেখে দেখলাম। মূল রাস্তায় কোনো স্টল নেই। এনজিওদের নাকি স্টল দেয়া হয় নি, স্টল দেয়া হয় নি আলতুফালতু বইবিক্রেতাদের। এটা ভালো। কিন্তু ‘উন্মাদ’ স্টল পেল না কেন? বইমেলায় দু’দুটো ইউনিট দিয়ে দিস্তা দিস্তা কাগজ বিক্রি করছে বসুন্ধরা পেপার। তারা স্টল পেলে ‘উন্মাদ’ পাবে না কেন? শুদ্ধচারী বাংলা একাডেমী কর্তৃপক্ষ শুদ্ধতা বাছতে গিয়ে লোমের বদলে উকুন রাখায় পক্ষপাতী কি? ধিক্!
লিটলম্যাগ প্রাঙ্গনেই মূলত পরিচিতজনদের দেখা মেলে। প্রথম দিন বলে পরিচিত মানুষ পেলামই না বলতে গেলে। দুজন বসে আসি, হঠাৎ করেই দেখি তৃষিয়া আপাকে। অনেকদিন পর দেখা। কিছুক্ষণ গুটুরগুটুর করে তিনিও চলে গেলেন। দেখি মুজিব মেহদী ভাই গল্প করছেন। তাঁর সাথে কিছুক্ষণ গল্প করলাম। তাঁর একটি বই বের হয়েছে- ‘ত্রিভুজাসম্ভাষ’ –‘শুদ্ধস্বর’ থেকে। সেখানে অনেকগুলো হাইকু, বাইকু আর সেনরু আছে। তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ (অন্তত আমার কাছে) হলো, তিনি এগুলো নিয়ে বইতেই একটা বিশ্লেষণধর্মী লেখা দিয়েছেন। হাইকু, বাইকু আর সেনরু নিয়ে জানতে হলে বইয়ের ওই লেখাটি পড়া জরুরি। মুজিব মেহদীর মাদ্রাসা শিক্ষা নিয়ে একটা ধারাবহিক লেখা ছাপা হচ্ছে ‘বাংলাদেশের শিক্ষা’ ওয়েব সাইটে। সেটি নিয়েও আলোচনা হলো কিছুক্ষণ। একজন কবি যখন শিক্ষা নিয়ে লিখেন, সেটি নানা অর্থেই ভিন্নমাত্রা ধারণ করে। মুজিব ভাইকে তাই অনুরোধ জানালাম এ ধরনের লেখা চালু রাখতে।
কিছুদিন আগেই তিনি একটি পুরষ্কার পেয়েছেন- ‘লোক সাহিত্য পুরষ্কার’। এ উপলক্ষ্যে লিটলম্যাগ ‘লোক’ একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছে যেখানে অন্য অনেকের সাথে আমারও একটি লেখা আছে মুজিব মেহদীর ‘মাদ্রাসা শিক্ষা: একটি পর্যবেক্ষণ সমীক্ষা’ বইটির ওপর। কথা বলতে বলতেই জানা গেল লোক-সম্পাদক অনিকেত শামীম আছেন সামনেই। আগে ইমেইলে কথা হলেও সরাসরি পরিচয় হয় নি। পরিচয়পর্বের পর হাতে পেলাম ‘লোক’–এর একটি সৌজন্য লেখক-কপি।
ওপাশে দেখি গল্প করছেন শিক্ষক-গবেষক-সাহিত্যিক মাসুদুজ্জামান স্যার। গিয়ে পরিচয় দিলাম, নাম বলতেই অবশ্য তিনি চিনে ফেললেন। তাঁকে আমি চিনি বহুদিন ধরেই- তিনি আমাদের ‘লালসালু’ পড়াতেন সরকারী তিতুমীর কলেজে। মাস তিন-চারেক পড়িয়ে তিনি চলে আসলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে- শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে (আইইআর)। এইচএসসি পাশ করে আমিও ভর্তি হলাম সেখানে। স্যারের ভাষায়- আমি তাঁর বিরলতম ছাত্রদের একজন; যাকে কিনা দুই জায়গাতেই আমি পেয়েছি। তবে আইইআরের স্যারের কোর্স পুরোপুরি পাই নি, কারণ তিনি তখন পড়ালেখার জন্য বাইরে- যা দেখতাম মাঝেমাঝে তিনি ঢাকায় এসে আইইআরে কাজ করছেন। দেখাসাক্ষাৎ না হওয়ায় মাঝখানে অনেকদিন কথাবার্তা ছিল না। সম্প্রতি ফেসবুকের সুবাদে সেই যোগাযোগটা আবার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
স্যারের সাথে কথাবার্তা হলো অনেকক্ষণ। তাঁর বই নিয়ে, কাজ নিয়ে; আমার বই নিয়ে, কাজ নিয়ে। পেশাগত অর্থে আমি এখন স্যারের সহকর্মী, ভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। সুতরাং কাজ নিয়ে কথা হবেই। তিনি যেহেতু জেন্ডার-সম্পর্কিত বিষয়গুলো নিয়ে লিখেন, অনুরোধ জানালাম- হিজড়াদের নিয়ে কিছু লেখা যায় কিনা। জেন্ডার বলতেই আমরা সাধারণত নারী-পুরুষ, তাদের সামাজিক সম্পর্ক ইত্যাদি ইত্যাদি ভেবে ফেলি- কিন্তু হিজড়ারা কোন জেন্ডারের মধ্যে পড়ে? দেখলাম, স্যারের কিছু ভাবনাচিন্তা আছে এ নিয়ে। আমার ভাবনাগুলোও শেয়ার করলাম। আশা করা যায়, আগামী বছর কিংবা তার পরের বছর তাঁর কাছ থেকে এই বিষয়ে একটা বই পাবো। পাবো না?
মাসুদুজ্জামান এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার শিক্ষক বরেন্দু মণ্ডলের যৌথ সম্পাদনায় ‘সেলিনা হোসেনের কথাসাহিত্য: দেশ-কাল-জাতি’ বইটি নেড়েচেড়ে দেখলাম, প্রকাশিত হয়েছে ‘লেখাপ্রকাশ’ থেকে। তিনি জানালেন, ভারতের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সেলিনা হোসেনের লেখা পাঠ্য। বইটি হয়তো সেই চাহিদা মেটাবে অনেকটা, কিন্তু তার বাইরে গিয়েও একজন জীবিত লেখক ও তাঁর লেখার ওপর প্রকাশিত অন্যের আলোচনার আবেদন অনেক- মূল লেখক তাতে জানতে পারেন তাঁকে নিয়ে অন্যরা কী ভাবছেন, কী মূল্যায়ন করছেন। এ বছর হাতে টাকাপয়সা নেই, থাকলে বইটি আজকেই কিনে ফেলতাম।
অনেকটা সময় পার করেছি বইমেলায়। পরিচিত কেউ বোধহয় আর আসবে না। আমরা দুজন আস্তে আস্তে হাঁটা ধরলাম বাসার দিকে। জানি না আবার কখন আসা হবে বইমেলায়। ওই, শোনা কথায় দিন চালাতে হবে এখন।
দেশের বাইরে থাকার কারণে যারা বইমেলা মিস করছেন, তাঁরা সান্ত্বনা পেতে পারেন- আপনার মতোই আমিও মিস করছি বইমেলা- হয়তো আরও প্রকটভাবে- কারণ আমি তো আছি দেশেই, দেশে থেকেও শোনা কথায় পার করতে হচ্ছে আমার এই সুস্বাদু বইমেলাকে!