শিক্ষাবিজ্ঞানে যারা পড়ালেখা করেন, তারা শুরু থেকেই জানেন মানুষকে শিক্ষিত আর অশিক্ষিত বলে আলাদা করা যায় না বা করা ঠিক না। শিক্ষাবিজ্ঞানে পড়ালেখা না করাও অনেকে এটা জানেন, কিন্তু তাদের সংখ্যা বোধহয় কম। ফলে বিভিন্ন লেখা-আলোচনা-বক্তব্যে প্রায়ই ‘শিক্ষিত’ না হওয়ার খেদোক্তি শুনি। এই শিক্ষিত হওয়া বা না-হওয়ার ব্যাপারটা আসলে কী?
একজন মানুষ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পড়ালেখা করলে শিক্ষিত, না করলে অশিক্ষিত– এ-ধারণার কোনো ভিত্তি নেই। হয় এদিকে, না-হয় ওদিকে- এ ধরনের বিভাজন প্রায়ই মারাত্মক হয়। শিক্ষার ফলাফলকে বৃহত্তর অর্থে দুভাগে ভাগ করা যেতে পারে। এক. মানুষের মধ্যে মন্যুষত্ববোধ জাগ্রত হওয়া, নিজেকে পরিশীলিত করা এবং নিজেকে মানবিক ও সামাজিক গুণসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা। দুই. নিজের দক্ষতা ও যোগ্যতার বিকাশ ঘটানো।
উপর্যুক্ত সংজ্ঞার বিচারে একজন নিরক্ষর কৃষক বা জেলে যেভাবে নিজের কাজ দক্ষতার সঙ্গে করেন, তাতে তাদেরকে অশিক্ষিত বলার কারণ নেই। সুসজ্জিত অফিসে চাকুরিরত ডিগ্রিধারী ব্যক্তি নিজের কাজ যেভাবে সামলান, একজন কৃষজ বা জেলেও তার কাজ তার মতো করেই সামলান। একজনের কাজ আরেকজনকে দিয়ে করানো সম্ভব না। দক্ষতা ও যোগ্যতার বিচারে তাই কেউই অশিক্ষিত নন। অন্যদিকে মন্যুষত্ব, সামাজিক ও নানা ধরনের মানবিক গুণাবলীর বিচারে মানুষকে ভাগ করতে গেলে দেখা যায়- এসব বিষয়ের সাথে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সম্পর্ক যতোটুকু থাকা প্রয়োজন, সত্যিকার সম্পর্ক সে তুলনায় খুব কমই দেখা যাচ্ছে। ফলে একদিকে যেমন একজন মাস্টার্স বা পিএইচডি ডিগ্রিধারী ব্যক্তিকে ফাইল আটকিয়ে বিনা দ্বিধায় ঘুষ খেতে দেখা যায়, অন্যদিকে রিকশায় পড়ে থাকা লাখ টাকা ফিরিয়ে দেওয়া সৎ কিন্তু নিরক্ষর রিকশাচালকের সন্ধান মেলে হামেশাই। তো, এই বিচারে কে আসলে শিক্ষিত? শিক্ষার কাজই যদি হয় মন্যুষত্ব জাগ্রত করা, তাহলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা আসলে কতোটুকু কার্যকর?
সুতরাং মানুষকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ভিত্তিতে ‘শিক্ষিত’ আর ‘অশিক্ষিত’ হিসেবে ভাগ করাটা কোনোমতেই যৌক্তিক হয় না। মানুষকে বড়জোড় সাক্ষর আর নিরক্ষর- এ-ধরনের ভাগে রাখা যেতে পারে। কিংবা আরেকটু এগিয়ে গিয়ে ‘প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত’ এবং ‘প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত নয়’ – চাইলে এরকম ভাগও করা যেতে পারে। তারপরও চটজলদি কথা বা শব্দ হিসেবে আমরা মানুষকে ‘শিক্ষিত’ বা ‘অশিক্ষিত’ হিসেবে ভাগ করেই ফেলি। কাজটি ঠিক না হলেও শব্দগুলোর অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝতে সমস্যা হয় না। প্রশ্ন হলো- প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আমরা আসলে ‘শিক্ষিত’ হতে পারছি? কতোটুকু পারছি?
প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পড়ালেখার সাথে ‘শিক্ষিত’ হওয়ার এই বিষয়টা নিয়ে আলাপন প্রকৃতপক্ষে অনেক পুরনো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কিংবা জগদীশ চন্দ্র বসুর বিভিন্ন লেখা থেকে আমরা জানতে পারি, তাঁরা আজ থেকে শতবর্ষেরও অধিক আগে প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখার সাথে শিক্ষিত হওয়া বা না-হওয়ার সম্পর্ক খুঁজেছেন। বিশেষত পড়ালেখা করা অনেক তরুণ-যুবক যে সত্যিকার অর্থে শিক্ষিত হতে পারছে না, তাতে তাঁদের খেদ ভালোভাবেই প্রকাশিত হয়েছে। এ নিয়ে সে-সময়কার প্রাজ্ঞজনেরা তাঁদের অতীতের সাথে তুলনা করে বরং আক্ষেপই করেছেন।
আজকে যদি আমরা আমাদের সময়ের সাথে সেই সময়ের একটি তুলনা করি, তাহলে এই খেদ বাড়বে নাকি কমবে? ছোটখাট কিছু উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। শিক্ষা মানুষের মধ্যকার সহিষ্ণুতা বাড়ায়। আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে এদেশে ডিগ্রিধারী মানুষের সংখ্যা অনেক কম ছিল। নানা বিষয়ে তখনকার মানুষের সহিষ্ণুতার সাথে এখনকার মানুষের সহিষ্ণুতার তুলনা করলে আমরা কি আশাপ্রদ চিত্র পাবো? বিভিন্ন ধর্মীয় বা সামাজিক বিষয়াদিতে এদেশের তারকা ক্রিকেটাররা ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে যে পরিমাণ বিরূপ প্রতিক্রিয়া পান, তাতে কি মনে হয় না প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা আমাদেরকে যথেষ্ট পরিমাণে ‘শিক্ষিত’ করতে পারেনি? ভাইয়ের সাথে বোনের, স্বামীর সাথে স্ত্রীর ছবিও অনেকে ফেসবুকে আপলোড করতে পারেন না কদর্য মন্তব্যের কারণে। অনলাইন পত্রিকার কলামের নিচে মন্তব্যের ঘরে নোংরা মন্তব্যের ছড়াছড়ি কি আমাদের ‘শিক্ষিত’ হওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী করে? দিনের পর দিন শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকার উপরের দিকেই আমাদের অবস্থান। অথচ যে হারে ডিগ্রিধারী মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, এসব বিষয় তো সেই হারে কমে আসার কথা!
কিন্তু আসছে না। আসছে না বলেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সাথে ‘শিক্ষিত’ হওয়ার সহসম্পর্কটি প্রশ্নের মুখে পড়েছে। অনেকে হয়তো বলতে পারেন, আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রে এ সহসম্পর্ক কখনোই ছিল না। আগে তা প্রকাশের মতো যথেষ্ট প্ল্যাটফর্ম বা সুযোগ ছিল না, এখন অনলাইনে নানা প্ল্যাটফর্ম হওয়ায়, মানুষে-মানুষে যোগাযোগের বৃহত্তর সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় তা দিন দিন দৃশ্যমান হচ্ছে। এই যুক্তি মেনে নেওয়া যেতে পারে, যদিও ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ সেটিকে দ্বিধাহীনভাবে মেনে নিতে চায় না। কিন্তু যুক্তিটি মেনে নিলেও প্রশ্ন তোলা যেতে পারে, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ তো বিভিন্ন ধরনের নেতিবাচকতা কমানো। সেটি তাহলে কেন দৃশ্যমান হচ্ছে না?
আমাদের বর্তমান শিক্ষানীতির শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অংশে খুব সুন্দরভাবে কয়েকটি কথা লেখা আছে। সেখানে বলা হয়েছে:
শিক্ষানীতির মূল উদ্দেশ্য মানবতার বিকাশ এবং জনমুখী উন্নয়ন ও প্রগতিতে নেতৃত্বদানের উপযোগী মননশীল, যুক্তিবাদী, নীতিবান, নিজের এবং অন্যান্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, কুসংস্কারমুক্ত, পরমতসহিষ্ণু, অসাম্প্রদায়িক, দেশপ্রেমিক এবং কর্মকুশল নাগরিক গড়ে তোলা। পাশাপাশি শিক্ষার মাধ্যমেই জাতিকে দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার বৈশিষ্ট্য ও দক্ষতা অর্জন করতে হবে। এই শিক্ষানীতি সংবিধানের নির্দেশনা অনুযায়ী দেশে গণমুখী, সুলভ, সুষম, সর্বজনীন, সুপরিকল্পিত, বিজ্ঞান মনস্ক এবং মানসম্পন্ন শিক্ষাদানে সক্ষম শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার ভিত্তি ও রণকৌশল হিসেবে কাজ করবে। এই আলোকে শিক্ষার নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য, লক্ষ্য ও নীতিগত তাগিদ নিম্নরূপ :
…২. ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনে নৈতিক, মানবিক, সাংস্কৃতিক, বিজ্ঞানভিত্তিক ও সামাজিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠাকল্পে শিক্ষার্থীদের মননে, কর্মে ও ব্যবহারিক জীবনে উদ্দীপনা সৃষ্টি করা।
৩. মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করে তোলা ও তাদের চিন্তা-চেতনায় দেশাত্মবোধ, জাতীয়তাবোধ এবং তাদের চরিত্রে সুনাগরিকের গুণাবলীর (যেমন: ন্যায়বোধ, অসাম্প্রদায়িক-চেতনাবোধ, কর্তব্যবোধ, মানবাধিকার সচেতনতা, মুক্তবুদ্ধির চর্চা, শৃঙ্খলা, সৎজীবনযাপনের মানসিকতা, সৌহার্দ্য, অধ্যবসায় ইত্যাদি) বিকাশ ঘটানো।…
৫. দেশজ আবহ ও উপাদান সম্পৃক্ততার মাধ্যমে শিক্ষাকে শিক্ষার্থীর চিন্তা-চেতনা ও সৃজনশীলতার উজ্জীবন এবং তার জীবন-ঘনিষ্ঠ জ্ঞান বিকাশে সহায়তা করা।…
৭. জাতি, ধর্ম, গোত্র নির্বিশেষে আর্থসামাজিক শ্রেণী-বৈষম্য ও নারীপুরুষ বৈষম্য দূর করা, অসাম্প্রদায়িকতা, বিশ্ব-ভ্রাতৃত্ব, সৌহার্দ্য ও মানুষে মানুষে সহমর্মিতাবোধ গড়ে তোলা এবং মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে তোলা।…
৯. গণতান্ত্রিক চেতনাবোধ বিকাশের জন্য পারস্পরিক মতাদর্শের প্রতি সহনশীল হওয়া এবং জীবনমুখী বস্তুনিষ্ঠ ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি বিকাশে সহায়তা করা”। (জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০, পৃ. ১)
ভেবে দেখুন তো, কথায় কথায় আমরা যে ‘শিক্ষিত’ শব্দটি ব্যবহার করি, সেই শিক্ষিত হওয়ার কোনো বিষয়টি আমাদের বর্তমান শিক্ষানীতিতে কোথায় অনুপস্থিত? শুধু বর্তমান শিক্ষানীতিতেই নয়, এর আগেও যেসব নীতি বা শিক্ষা-বিষয়ক সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, সেগুলোতেও এসব অনেক ভালো ভালো কথা বলা হয়েছে এবং এসবের আলোকেই শিক্ষার নানা কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন করা হয়েছে। তাহলে ‘শিক্ষিত’ মানুষ প্রত্যাশিত হারে পাচ্ছি না কেন আমরা?
তাহলে কি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যর্থ? প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়া তো একটি রাষ্ট্র চলতে পারে না। আর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যর্থ হলে এর ফল হিসেবে সেই সমাজ ও রাষ্ট্রের ব্যর্থতার মুখে পড়ার কথা। শিক্ষার ফলে যে মনুষ্যত্ববোধ আমাদের জাগ্রত হওয়ার কথা, সেখানে কি আমরা সার্বিকভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছি? বিশেষ করে শিক্ষিতরা?
প্রশ্নগুলোর উত্তর বের করা জরুরি। জরুরি এ কারণে যে, শিক্ষা ছাড়া একটি সমাজ ও রাষ্ট্রের সার্বিক বিকাশ ও উন্নয়ন অসম্ভব। আর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সেখানেই সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে। এই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাই যদি গলদযুক্ত নাগরিক সৃষ্টি করে, তাহলে সমাজ ও রাষ্ট্রের যে সার্বিক উন্নয়নের কথা বলা হয়, সেটি আর সম্ভব হবে না।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যর্থতা ও ব্যর্থতার হার নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে; তবে সম্ভবত আমরা সবাই একমত হবো যে, বর্তমান প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় প্রত্যাশানুযায়ী ফল পাওয়া যাচ্ছে না। প্রত্যাশার সীমানা নির্ধারণ করে দিয়েছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনাগুলো; কিন্তু সে অনুসারে আমরা এগুতে পারছি কি? বর্তমান নিবন্ধটুকু এ প্রশ্নটি দিয়েই শেষ হোক, উত্তর খোঁজার প্রয়াস থাকবে পরবর্তী লেখায়।