পরশু ঢাকা যেতে হবে। তেমন জরুরি কাজ নেই – তবে শুক্র আর শনিবার যেহেতু অফিস ছুটি – কিছু খুচরো কাজ সারা দরকার। বৃহস্পতিবার বিকেলে গেলে রাতটা ঘুমিয়ে পরের ছুটির দুদিনে কাজ সেরে রবিবার সকালের মধ্যেই ফিরে আসা যায়।
হারানাথ বাবুকে ফোন দিলাম। বন্ধ বোধহয়। স্টেশনে টিকিট কিনতে গেলে হয় সকাল ১০টার পরপর যাই, নয়তো বিকাল চারটার কিছু পরে। ওই সময়েই এসির টিকিটগুলো ছাড়ে। হারানাথ বাবু রেলের কেউ নন; তবে রেলেই তার জীবন চলে। আমার মতো একটু স্বচ্ছল চাকুরিজীবি বা ব্যবসায়ীরা চান যেকোনো উপায়ে এসির টিকিট কিনতে। কিন্তু এই স্টেশন থেকে যে ট্রেনগুলো ছাড়ে, সেখানে এসির বগি মাত্র একটি। কাউন্টারগুলোও অনেকদিন ধরে কড়া নিয়ম মানছে। স্টেশনে না গিয়ে বা লাইনে না দাঁড়িয়ে টিকিট যোগাড় করা আমাদের চেয়েও বড়লোকদের কাজ, ফলে কাউন্টার খোলার অনেক আগে থেকেই দীর্ঘ লাইন শুরু হয়। হারানাথ বাবুর আয়রোজগার এখান থেকেই।
চাকুরির কারণে আমার পক্ষে কাটায় কাটায় ১০টা বা চারটায় স্টেশনে থাকা সম্ভব নয়, আগে যাওয়ার প্রশ্ন তো উঠেই না। হারানাথ বাবুই এখানে ভরসা; শুধু আমার নয়, অন্য অনেকেরও। তিনি লাইনে দাঁড়ান। কখনও বিশ, কখনও বা ত্রিশ জনের পর। আমাদের যাদের যেতে একটু দেরি হয়, তারা গিয়ে হারানাথ বাবুর জায়গাটায় দাঁড়াই। লাইনের জায়গাটা রাখার জন্য টিকিট কেনার পর তাকে কিছু টাকা ধরিয়ে দিই। আমাদের সময় বাঁচলো, তারও কিছু টাকা হলো। সারাদিন তিনি এভাবে কয়েকবার লাইনে দাঁড়ান। শুরুটা তিনিই করেছিলেন, দেখাদেখি আরও কয়েকজন এই ব্যবসা শুরু করেছে।
একদিন এমনিই জিজ্ঞাসা করেছিলাম, “এভাবে আয়-উপার্জন হয় কিছু”?
তিনি হাসিমুখে বলেছিলেন, “সংসারডা চইলি যায় স্যার”।
যদিও লাইন মেনেই টিকিট কাটছি, কিন্তু মধ্যবিত্তসুলভ খচখচানিটা যায় না কখনওই। শেষ বিচারে এও তো অন্যায়ই! দুর্নীতিও হয়তো। সুবিধে হলো, আশেপাশে এতো বড় বড় সব ঘটনা ঘটে, এগুলোকে এখন আর কেউ দুর্নীতি হিসেবেও দেখে না।
কিন্তু আজকে কী হলো ঠিক বুঝতে পারছি না। ফোনের চার্জ শেষ হয়তো। বেশ ক’বার ফোন দিলাম। মোবাইল অপারেটরের নারীকণ্ঠ একঘেয়ে সুরে বলেই যাচ্ছে, ‘Sorry, the number you dial is unavailable…’
একবার ভাবলাম ইন্টারনেটে টিকিট কেটে ফেলি। আগে কখনও কাটিনি, যদি ভুলচুক করে ফেলি! সাহসে কুলালো না। ভাবলাম, টিকিট যেহেতু কাটতেই হবে, দেরি করার মানে হয় না। অফিস থেকে আধা ঘণ্টা আগেই বের হলাম স্টেশনের উদ্দেশ্যে।
দীর্ঘ লাইন। যথারীতি। কিন্তু হারানাথ বাবুকে দেখছি না কোথাও। ব্যাপারটা কী? এই বয়সে এসে নিশ্চয়ই কাজ ছেড়ে দেননি! তার যেরকম স্বাস্থ্য – একদিন বলেছিলেনও – “আমার লাইগি এডিই আরামের কাম স্যার। এই বয়সে আইসি এর চাহাতে বেশি কিছু কইরতে পাইরবোনিকো”।
কাউন্টার এখনও খুলেনি। লাইনের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত চোখ বুলালাম। না, হারানাথ বাবু নেই; তার মতো লাইনে দাঁড়ানো অন্যরা অবশ্য আছে। এদের সার্ভিস আগে নিইনি। এরা বিনিময়ে কতো নেয় তাও জানি না। হারানাথ বাবুকে না পেলে ওদের কারোর ওপরই ভরসা করতে হবে। দামাদামি করতে হবে কিনা বুঝতে পারছি না। নাকি নিজেই লাইনে দাঁড়িয়ে যাবো? আজ তো তেমন কাজও নেই বাসায়। দেখি না একটা দিন নিয়ম মেনে।
ইতস্ততভাব দেখে কিনা জানি না, লাইনের একটা ছেলে বেশ কিছুক্ষণ ধরে আমার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে। ওদিকে তাকাতেই হাত তুললো। কাছে যেতেই বললো, “আপ্নে তো হারানাথ কাকার কাস্টমার”।
কাস্টোমার শব্দটা কানে বাজলেও বললাম, “হ্যাঁ, কিন্তু তিনি কোথায়?”
ছেলেটা অবাক হয়ে বললো, “আপ্নে জাইনতেন না? তাইলে মনয় গত একমাস ঢাকাত যান নাই”!
গত এক মাসে ঢাকা যাওয়া-না-যাওয়ার মানেটা যদিও ঠিক বুঝলাম না; বললাম, “না, গত এক মাসে যাওয়া হয় নাই। কিন্তু হারানাথ বাবু গেলেন কই?”
ছেলেটা জানালো, মাসখানেকের মতোই হবে তিনি মারা গেছেন।
সত্যি বলতে কি, ওই টিকিট কিনতে গিয়ে লাইনে দাঁড়ানোর জন্য টাকা দেওয়া ছাড়া আর কোনো বিষয়ে হারানাথ বাবুর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। কিছু কিছু বিষয় নিয়ে টুকটাক কথা যে হয়নি, তা নয়; তবে সেটা ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে না। বিস্ময় নিয়ে লক্ষ্য করলাম, কেমন যেন একটা হালকা বেদনাবোধ হচ্ছে। আবার এও সন্দেহ হচ্ছে, এ-আসলে বেদনাবোধ, নাকি কিছুটা মায়া? নাকি এতোদিনকার খুচরো সম্পর্কের হালকা বাঁধন?
যা হোক, ওই ছেলেটির কাছ থেকে লাইন কিনলাম। টাকা বেশি নিলো না। জানালো, আমি হারানাথ বাবুর নিয়মিত কাস্টোমার, আমার কাছ থেকে তিনি যা নিতেন, সে তার বেশি নিবে না। আমিও কী মনে করে হারানাথ বাবুর বাড়ি কোথায় তার কাছ থেকে জেনে নিলাম। ছেলেটি শুধু জানাতে পারলো, মোহনপুর বাজারে নেমে একটু বায়ে গিয়ে পোস্ট অফিসের ওখানে কাউকে জিজ্ঞাসা করলে তার বাড়ি দেখিয়ে দিবে।
স্টেশন থেকে বেরিয়ে কী করবো বুঝতে পারছিলাম না। বাসায় কিছু করার নেই। বারবারই মনে হচ্ছে, হারানাথ বাবুর বাড়ি যাই, গিয়ে দেখে আসি। আবার এও মনে হচ্ছে, এতো আদিখ্যেতা মনে আসছে কেন? এমন তো কোনো সম্পর্ক নেই যে সামাজিকতার জন্য হলেও যেতে হবে! দোনামোনা করতে করতেই ঠিক করলাম, ক্ষতি তো আর নাই, ঘুরে আসি। একটা নতুন জায়গাও দেখা হলো!
রেলগেইট থেকে মোহনপুর অটোরিকশা যায়। এক অটোরিকশায় ছয় জন। আরও পাঁচ যাত্রীর সঙ্গে উঠে বসলাম। মোহনপুর পোস্ট অফিস খুঁজে বের করতে কষ্ট হলো না। ওখানে একজনকে জিজ্ঞাসা করতেই বললো, “শ্রাদ্ধ বাড়িত যাইবেন?”
বুঝতে পারলাম না। বললাম, “না, না, শ্রাদ্ধ বাড়িটাড়ি না। হারানাথ বাবুর বাড়ি”।
লোকটা কী বুঝলো কে জানে, একটা রাস্তা দেখিয়ে বললো, “ঐ ইদিকে বড় আমগাছের ওখেনে যায়লেই টিনের বাড়িখিন দেইকতে পাবেন”।
তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। আমগাছটা আসলেই বিশাল। ওটার নিচে যেতেই বুঝা গেল, সামনের বাড়িতে কোনো একটা অনুষ্ঠান হয়েছে বা হবে। গিয়ে হারানাথ বাবুর বাড়ির ঠিকানা জিজ্ঞাসা করবো কিনা ভাবতে ভাবতে এগিয়ে গেলাম। তেমন কেউ নেই বাড়ির সামনে।
উঠানের পাশে অস্থায়ী ছনের ঘর। ওখানে কয়েকটি চুলায় আগুন ধরানো হয়েছিলো, ছাই এখনও হালকা জ্বলন্ত। উঠানে বেশ কিছু টেবিল-চেয়ার। একপাশে মাটিতে কাপড় বিছানো, অন্যপাশে অনেকগুলো বড় হাড়িপাতিল। বেশ খাওয়াদাওয়া হয়েছে মনে হলো। ছনের ঘরটিতে কিশোরবয়সী একটি ছেলে কী যেন করছে। ডেকে জিজ্ঞাসা করলাম, “এখানে হারানাথ বাবুর বাড়িটা কোনটা বলতে পারেন?”
ছেলেটি কিছুটা অবাক হলো মনে হয়। বললো, “ক্যান?”
বিরক্ত হলাম। বিরক্তি প্রকাশ করেই বললাম, “বলতে অসুবিধা আছে? জানলে দেখিয়ে দিন, আমার উপকার হবে”।
ছেলেটি কাঁপাকাঁপা গলায় বললো, “এডিই। বাবা তো নাই। আইজকেই শ্রাদ্ধ হইলো”।
আমি ঠিক কী বলবো বুঝতে পারলাম না। খুবই লজ্জা পেলাম। অনেক কষ্টে বললাম, “আমি আসলে বুঝতে পারিনি এটা হারানাথ বাবুর বাড়ি। আর আজ যে শ্রাদ্ধ সেটাও জানতাম না”।
পরিচয় দিলাম। বললাম, “এতোদিনের সম্পর্ক হারানাথ বাবুর সাথে। আজ স্টেশনে গিয়ে তার মৃত্যুর খবর পেলাম। তাই মনে হলো বাড়ি গিয়ে একটু খোঁজ নিই”।
ছেলেটি খুব খুশি হলো। মাকে ডেকে নিয়ে আসলো। তার মা, অর্থাৎ হারানাথ বাবুর বিধবা স্ত্রী, মনে হলো কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলেন না। শুধু জানালেন আমি আসায় তিনিও খুশি হয়েছেন।
শ্রাদ্ধের খাবারের পর্ব শেষ। তবে এখনও ভাত-নিরামিষ তরকারি আছে। আমি খাবো কিনা জিজ্ঞাসা করলো। সাধারণত শ্রাদ্ধবাড়িতে খুব কম যাই, ভালোলাগে না; কিন্তু এখানে রাজি হলাম। ছেলেটি যত্ন করে খাওয়ালো। বললো, “বাবা একদিন বুইলেছিলো আপনের কথা। আপনে নাকি টিকিট কিনতে যাইয়ে বাবাক চা খাওয়াতে লিয়ে যায়তেন”।
মানুষ যে কতো ছোটখাটো বিষয় মনে রাখে! চা খেতাম আসলে আমি, লাইনে মানুষজন কম থাকলে কোনো কোনোদিন ধরে নিয়ে যেতাম কথা বলার জন্য। তিনি মাঝেমধ্যে খেতেন, বেশিরভাগ সময় একটা বা দুটো বিস্কুট খেয়ে পানি খেতেন।
চলে আসার সময় কী বলবো বুঝতে পারছিলাম না। শ্রাদ্ধবাড়িতে কিছু না কিছু নিয়ে যাওয়ার নিয়ম, আমি কিছু নিয়ে আসিনি। শ্রাদ্ধ যে তাই তো জানতাম না! ছেলেটির মাথায় হাত রেখে বললাম, “তোমার বাবা অনেকের উপকার করেছেন। আশির্বাদ করি তুমি অনেক বড় হও। আর এই…”
বলতে বলতে মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করতে যাচ্ছিলাম। পরক্ষণেই মনে হলো, থাক, টাকা না দিই। হয়তো বেমানান হবে। আর যদি কিছু মনে করে ছেলেটি! মুহূর্তেই কথা পাল্টে বললাম, “…আর আমার এই কার্ডটা রাখো। যোগাযোগ করো”।
জানি যোগাযোগে কিছু হবে না, আমি কিছু করবো না বা করার সাধ্যও নাই; কিন্তু এ-ধরনের বিদায়বেলায় এরকম একটি কার্ড বেশ কাজে দেয়।
মাসখানেকেরও বেশি সময় পর আবারও ঢাকা যাওয়ার দরকার হলো। এবারও নিজেই টিকিট কাটতে গেলাম। লাইন অনেক বড়। মনে মনে আগের দিনের ছোকরাটাকে খুঁজছি। এমন সময় মনে হলো কে যেন স্যার স্যার বলে ডাকছে! লাইনে দশ-বারোজনের পর একটি ছেলে দাঁড়িয়ে। চেনা চেনা লাগছে। এই ছেলেটিই ডাকছে। ভ্রু-কুঁচকে কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই বললো, “স্যার, হামাক চিনতে পাইরছেন না? হামার বাবা হারানাথ দত্ত, এখেনে লাইনে দাঁড়াইতেন। শ্রাদ্ধের দিন হামারে বাড়িত গেছিলেন”।
সাথে সাথেই চিনলাম। আগেরবার শ্রাদ্ধবাড়ির পোশাক, চুল কামানো সব মিলিয়ে যেভাবে দেখেছি, আজকে স্বাভাবিকভাবেই অন্যরকম। বললো, “আপনাক লাইনে দাঁড়াইতে হবে না। তারিখ বুলেন আর টেকা দেন, আমিই টিকিট কাইটে দিছি”।
মিনিট বিশেক অপেক্ষার পর সে টিকিট নিয়ে আসলো। আমি গেটের কাছে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম ওকে কতো দেয়া যায়। কিছুটা বেশি দিবো নাকি একই রেট রাখবো?
টাকাটা নেয়ার পর বললো, “এরপর থাইকে আসার আগেই ফোন দিয়েন। বাবার ঐ লম্বরডাই আছে, আমি ব্যবহার কইরছি। আপনে ফোন দিলে আপ্নের লেইগে লাইন থাইকবে স্যার”।
ঢাকার টিকিট পকেটে নিয়ে স্টেশনের টং দোকানে চা খেতে খেতে ভাবছিলাম, লাইন কোনোদিন খালি থাকে না। নতুন কেউ জায়গা দখল করে। বরং সুবিধেই হয় তাতে। হারানাথ বাবুর আমলে আমাকে ঠিকই লাইনে দাঁড়াতে হতো, তার উত্তরপ্রজন্ম তো টিকিটটাও কেটে আনছে আমার হয়ে।
ভাবছিলাম, আমি হঠাৎ অন্তহীন যাত্রায় রওনা হলে আমার ভূমিকায় কে লাইনে দাঁড়াবে?
[উৎসর্গ: এক অলস দুপুরে মোবাইল ফেইসবুকে স্ক্রল করতে করতে কোনো এক বন্ধুর স্ট্যাটাস পড়ছিলাম। ওখানে হারানাথ/হারাধন বাবু, রেলের টিকিটের জন্য লাইনে দাঁড়ানো, ৩১ বছর ধরে এই কাজ করছেন… এমন কিছু লাইন ছিলো। তাৎক্ষণিকভাবে কিছু মনে হয়নি, সন্ধ্যেয় হঠাৎ গল্পের প্লটটি মাথায় আসে; কিন্তু ততোক্ষণে মূল স্ট্যাটাসটি তো ভুলেছিই, কে লিখেছিলেন তাও ভুলে গেছি। গল্পটি চটজলদি লিখে আঁতিপাতি করে অনেকক্ষণ ধরে বিভিন্নভাবে স্ট্যাটাসটি খুঁজলাম। কিছুতেই আর পেলাম না। ওইদিনই ফেইসবুকে এ-সংক্রান্ত একটি স্ট্যাটাস দিই, তাতে সাড়া মেলেনি কোনো। গল্পটি ফেইসবুকের সেই বন্ধুর উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত, যার স্ট্যাটাস এ-গল্পের আইডিয়ার যোগান দিয়েছে।
ধন্যবাদ: গল্পের সংলাপগুলো রাজশাহীর আঞ্চলিক ভাষায় রূপান্তর করেছেন নাজিয়া আমীর। তাঁকে ধন্যবাদ।]