প্রথমে ভেবেছিলাম, এই লেখার বিষয়বস্তু হবে শিক্ষাব্যবসা বা শিক্ষার নানা প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গ নিয়ে ব্যবসার বিষয়টি; কিন্তু পরে ভেবে দেখলাম, শিক্ষা নিয়ে ব্যবসার ধারণা এবং এর চর্চার বিষয়টি সম্পর্কে মোটামুটি সবাই অবগত। কিন্তু জ্ঞান বা জ্ঞানচর্চা নিয়ে আড়ালে-আবডালে কীভাবে ব্যবসা হচ্ছে, কিংবা মানুষের একটি অন্যতম অধিকার, শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে প্রধান উপাদানটিকে অবলম্বন করে জ্ঞানকে কীভাবে সুকৌশলে কুক্ষিগত করা হচ্ছে- সে বিষয়গুলো আলোচনায় আসে তুলনামূলকভাবে কম। মূল ধারার মিডিয়াগুলোতে তো বটেই, সুনির্দিষ্ট কর্মপন্থা নির্ধারণ করা হয় যে প্ল্যাটফর্মগুলোতে, সেখানেও এগুলো তেমনভাবে আলোচিত হয় না। উল্লেখ্য, শিক্ষাব্যবসা ও জ্ঞানব্যবসা দুটো আলাদা ধারণা। যদিও ব্যবসা করার ক্ষেত্রে এদের কর্মপদ্ধতি ভিন্ন- কিন্তু দুটোর মধ্যে আবার আন্তঃসম্পর্কও রয়েছে। জ্ঞানব্যবসার মূল উদ্দেশ্যে, যেহেতু, যারা শিক্ষাগ্রহণে আগ্রহী তাদের শিক্ষাক্ষেত্রটিকে কেন্দ্র করে ব্যবসায়িক রীতিগুলোকে এর অন্তর্নিহিত অংশ হিসেবে বিকশিত করা, সুতরাং সেখানে জ্ঞানব্যবসার উপাদানগুলো প্রায়শই শিক্ষাব্যবসাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। অপরদিকে শিক্ষাব্যবসার ধরনটি অনেকটাই প্রকাশ্য। সেখানে শিক্ষার্থীদের বেতনভাতা থেকে শুরু করে শিক্ষাগ্রহণের প্রতিটি প্রবেশগম্যতা কিংবা সুযোগ সৃষ্টির ক্ষেত্রগুলোতে টাকাপয়সার বিষয়টি মুখ্য হয়ে দাড়ায়। এখানে কোনো ধরনের আড়াল-আবডালের ব্যাপার নেই; বরং এই ব্যবসা কোনো কারণে ফুলে-ফেঁপে গেলে রাষ্ট্রকে বাধ্য হয়ে কিছু নিরাময়মূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। জ্ঞানব্যবসার বিষয়গুলো অপ্রকাশ্য, কিছুটা লুকোছাপার ব্যাপার সেখানে থাকে; কারণ এর সঙ্গে নৈতিকতার বিষয়টি জড়িত থাকে কোনো না কোনোভাবে কিংবা জ্ঞানের অধিকারের বিষয়গুলো যেহেতু প্রকাশ্যে আলোচিত হয় না, সুতরাং জ্ঞানব্যবসা এখানে বাড়তি সুবিধা কিছুটা পেয়ে থাকে। রাষ্ট্রেরও এসব বিষয়ে তেমন কোনো মাথাব্যাথা থাকে না। সুতরাং, শিক্ষাব্যবসার বিরোধীগোত্রের যারা, তাঁদের জ্ঞানব্যবসার এই বিষয়টি সম্পর্কে ওয়াকিফহাল হওয়া খুবই জরুরি এবং শিক্ষাব্যবসার বিরুদ্ধে যেভাবে নানা সময়ে আন্দোলন-সংগ্রাম সংগঠিত হয়, সেরকমই সোচ্চার হওয়া প্রয়োজন জ্ঞানব্যবসার বিরুদ্ধেও।
উদাহরণ দিলে বিষয়টি হয়তো পরিষ্কার হতে পারে। আমাদের দেশে প্রাথমিক পর্যায়ে পড়ালেখা করা শিশুদের জন্য বাধ্যতামূলক। এখন শিশু কোথায় পড়বে? মানে শিশুর পিতামাতা তাদের এলাকায় থাকা একাধিক বিদ্যালয়ের মধ্যে তাদের শিশুকে কোন বিদ্যালয়ে ভর্তি করাবে? প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়ার জন্য এদেশে অনেক বিদ্যালয় রয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে দশ ধরনের প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে কম খরচে পড়ার জন্য উপানুষ্ঠানিক বিদ্যালয় যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে খরুচে ইংরেজি মাধ্যমের বিদ্যালয়সমূহ। এর বাইরে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কমিউনিটি বিদ্যালয় কিংবা মাদ্রাসা ইত্যাদি নানা ধরনের বিদ্যালয় রয়েছে। একেক বিদ্যালয়ের পড়ালেখার মান একেকরকম। মানের বিষয়টি বিদ্যালয়ের ধরনের ওপর যেমন নির্ভর করে, তেমনি একই ধরনের একাধিক বিদ্যালয়ের নানা অনুষঙ্গের ওপর ভিত্তি করেও মানের পার্থক্য হতে পারে। এখন একই এলাকায় দু-ধরনের বা দুটো বিদ্যালয় রয়েছে যেখানে একটি বিদ্যালয়ের পড়াশোনার মান ভালো, অপরটির তুলনামূলকভাবে খারাপ। সাধারণভাবে দেখা যায় (ব্যতিক্রমও রয়েছে), যে বিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত সুবিধা, শিক্ষকমণ্ডলীর শিক্ষাগত ও প্রশিক্ষণগত যোগ্যতা কিংবা শিক্ষার্থীদের আর্থসামাজিক অবস্থা তুলনামূলকভাবে ভালো, সেই বিদ্যালয়ের পড়ালেখার মান কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে পরীক্ষায় পাশের হার ভালো। এখন এই মান বিচার করে কোনো শিক্ষার্থীর পিতামাতা তাদের সন্তানকে কোথায় পড়াতে চাইবেন? অবশ্যই যেখানে ভালো পড়ালেখা হয়, সেখানে। কিন্তু দেখা যায়, সেখানে প্রবেশাধিকার সীমিত এবং এই প্রবেশাধিকার নির্ধারিত হয়, অধিকাংশক্ষেত্রে, পিতামাতার আর্থিক সঙ্গতির ওপর ভিত্তি করে। এখন যার আর্থিক সঙ্গতি নেই, তার কি অধিকার নেই ভালো পড়ালেখার পরিবেশ পাওয়ার? শিক্ষাব্যবসা গড়ে ওঠে এ ধরনের ক্ষেত্রকে কেন্দ্র করেই। পাশাপাশি যে বিদ্যালয় দুর্বল, সেগুলোকে দুর্বল করে রাখার প্রক্রিয়াগুলোও মোটামুটি দক্ষতার সাথেই, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে, অনুসরণ করা হয়। রাষ্ট্র এসব ব্যাপারে যতোদিন পূর্ণমাত্রায় সচেতন না হবে, ততোদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যকার এই গুণগত পার্থক্যটুকু বজায় থাকবে। কারণ এই পার্থক্যটুকু না থাকলে ভালো বিদ্যালয় বা খারাপ বিদ্যালয়ের কনসেপ্টটুকুই থাকে না আর সেটি না থাকলে ভালো বিদ্যালয়ের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়।
অপরদিকে জ্ঞানব্যবসার প্রক্রিয়াগুলো সংগঠিত হয় আড়ালে, যেগুলো সম্পর্কে সাধারণভাবে জনমানুষের ধারণা থাকে না বা যেগুলো সরাসরি আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে সরাসরি প্রভাব কম ফেলে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যায়ের পড়ালেখার উদাহরণই দেয়া যাক। আজকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে যেসব বিষয় পড়ানো হয়, তার অনেককিছুই আউটডেটেড। এর একটি বড় কারণ, আমাদের কারিকুলাম ও সিলেবাস নিয়মিত আপডেট করা হয় না। একই কারিকুলাম ও সিলেবাস দিয়ে বছরের পর বছর পড়ানো হচ্ছে। এদিকে প্রতিটি বিষয়েই জ্ঞানবিজ্ঞানের নানা বিষয় যুক্ত হচ্ছে প্রতিনিয়তই। এখন কোনো বিশ্ববিদ্যালয় যদি মনে পড়ে তার শিক্ষার্থীদেরকে সর্বশেষ জ্ঞানবিজ্ঞানের সাথে পরিচয় করিয়ে দিবে, তাহলে সেটি এতোটা সহজ না-ও হতে পারে। বস্তুত, প্রতি মুহূর্তে নানাবিধ গবেষণার মাধ্যমে যেসব নতুন জ্ঞান সৃষ্টি হচ্ছে, সেগুলো সংরক্ষিত থাকে কপিরাইট ও পেটেন্ট দ্বারা; যেগুলো পেতে হলে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ খরচ করতে হবে। ধনী বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়তো প্রতিনিয়ত এসব জ্ঞান কেনার মতো পর্যাপ্ত পরিমাণ অর্থ রয়েছে; কিন্তু গরীব বিশ্ববিদ্যালয়, বিশেষ করে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কথা চিন্তা করতে পারি, যাদের শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন দেওয়ার পর অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও গবেষণা খাতে বরাদ্দ দেয়ার মতো টাকা থাকে না, তাদের কাছে বাড়তি অর্থ দিয়ে নিত্যনতুন জ্ঞান কেনাটা বিলাসিতার পর্যায়ে পড়ে। এমনকি পুরনোতর সংস্করণের বই পড়ে পড়ে শিক্ষার্থীদের পাশ করতে হয়। নতুন বই কেনার সামর্থ্য যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নেই! ফলে আমরা যা শিখি, তার এক বিরাট অংশই মূলত পুরনো; বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করে যাওয়ার পর খুব কম সংখ্যক মানুষ, যারা অধিকতর উচ্চশিক্ষার জন্য দেশে বা দেশের বাইরে যান, তারা ছাড়া বাকিরা হয়তো এসবের অনেক কিছু জানতেই পারে না।
যে জ্ঞানব্যবসার কথা উপরে বলা হলো, সেটা জ্ঞানব্যবসার একটিমাত্র দিক। এ বিষয়ে আরও অনেক ছোট উদাহরণ দেয়া যেতে পারে, দেয়া যেতে পারে বড় উদাহরণও। যেমন, পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব কত- এই তথ্যটুকু বা ক্ষেত্র-অনুসারে জ্ঞানটুকু অর্জনের জন্য আপনাকে-আমাকে আপাতদৃষ্টিতে কোনো খরচ করতে হচ্ছে না। যদি করতে হতো, তাহলে আমাদের কয়জন পড়ালেখা করতে পারতাম? যাবতীয় বইপত্র তো এসব নানা জ্ঞানে ভরপুর। হিসেব করে দেখুন, এ ধরনের জ্ঞান অর্জনের জন্য অর্থ খরচ করতে হলে আপনাকে বা আমাকে প্রতি বছর কতো পরিমাণ অর্থ খরচ করতে হতো? সেই সামর্থ্য কি আমাদের সবার আছে? কিংবা সামর্থ্য থাকলেও সব ধরনের জ্ঞানই আমাদেরকে কিনতে কেউ বাধ্য করতে পারে? জ্ঞানের ওপর মানুষের অধিকার কি জন্মগত নয়? মানুষ জন্মগ্রহণ করার পর থেকে প্রচুর জিনিস শেখে নিজ পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের নানা ধরনের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। সেগুলোর ওপর মূল্য আরোপ করা গেলে মানুষের উন্নতির যাবতীয় প্রক্রিয়াই কি স্তব্ধ হয়ে যেতো না? এ গেলো তুলনামূলকভাবে ছোট ক্ষেত্রের উদাহরণ! বড় উদাহরণ হিসেবে মোবাইল ফোনের কথাই বলা যায়। আমরা যদি লক্ষ্য করি, তাহলে দেখতে পাবো, অনেক মোবাইল কোম্পানির নতুন সেটগুলোর দাম বেশি হয়। কেন? কারণ ওতে অনেক ফিচার থাকে, থাকে নানা ধরনের সুবিধা, যা প্রচলিত সেটগুলোতে পাওয়া যায় না। কিন্তু সেটাই কি একমাত্র কারণ? না, কারণ হলো মোবাইল কোম্পানিগুলো এই বাড়তি জিনিস দেওয়ার জন্য নিজেরা গবেষণা করে থাকে, এবং এসব গবেষণার পেছনে তাদের যে খরচ হয়, তা (কিংবা তারচেয়েও বহু বহুগুণে বেশি) এই বাড়তি দাম থেকে তুলে নেয়। এখন প্রতিদ্বন্দ্বী অন্য মোবাইল কোম্পানির কথা বাদ দিলাম, কোনো শিক্ষার্থী যে কিনা মোবাইল টেকনোলজি নিয়ে পড়ালেখা করছে, সে যদি এটা জানতে চায়, তাহলে কি জানতে পারবে? পারবে না। কারণ এই জ্ঞানটুকু যেটি মোবাইল কোম্পানি নিজস্ব গবেষণা দ্বারা আবিষ্কার করেছে, তারা এটাকে অনেকটা সময় পর্যন্ত নিজেদের কাছে কুক্ষিগত রাখবে। ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বীকে তো নয়ই, এটা নিয়ে যারা পড়ালেখা করে, তারাও এই জ্ঞানের নাগাল পাবে না। ফলাফল, আজকের শিক্ষার্থী জানছে গতকালের জ্ঞান; আজকের জ্ঞান তার হাতের নাগালে নেই।
যারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জ্ঞানব্যবসা করে, তাদের যুক্তি হচ্ছে যে নতুন জ্ঞান তারা অর্থ খরচ করে আবিষ্কার করছে, তা থেকে কিছুটা মুনাফা তারা অর্জন করতেই পারে। যুক্তি সত্য। প্রশ্ন হলো, এই যে ‘কিছুটা মুনাফা’র কথা বলা হয়েছে, এই কিছুটা বলতে সত্যিকার অর্থে কতোটা বুঝায়? কতোদিন ধরে ব্যবসা করলে কিছুটা মুনাফা অর্জিত হতে পারে? আজকে আমরা যে কোকাকোলা বা পেপসি খাই, দুটো কোম্পানিই তাদের নিজস্ব কিছু ফর্মুলা
বা কেমিক্যাল ব্যবহার করে বলে দাবি করে, যার ভিত্তিতে দুটো পানীয়ের স্বাদ ভিন্ন হয়। অন্য কেউ যদি এই ফর্মুলা জানতে চায়, স্বাভাবিকভাবেই তা জানানো হবে না। প্রশ্ন হলো, একটি ফর্মুলা ব্যবহার করে একটা কোম্পানি কতো বছর মুনাফা করতে পারে? এ ধরনের জ্ঞান কুক্ষিগত করে রাখার নিয়মকানুন কী? পেটেন্ট করা মানেই কি জ্ঞান লুকিয়ে রাখা? জ্ঞানব্যবসার মূল সূত্রটা এসব প্রশ্নের মধ্যেই নিহিত।
এ ধরনের প্রশ্নও উঠতে পারে, কোম্পানি যদি তাদের ফর্মুলা বা সূত্র বলে দেয়, তাহলে তো তাদের ব্যবসা চলবে না। তাহলে কী উদ্দেশ্যে বা কেন তারা তাদের ফর্মুলা উন্মুক্ত করবে? আপাতদৃষ্টিতে প্রশ্নটা সঠিক মনে হয়। কিন্তু যদি উদাহরণ দেয়া যায় যে, উন্মুক্ত ফর্মুলা দিয়েও ব্যবসা করা সম্ভব এবং তা ভালোভাবেই, তাহলে নিশ্চয়ই এর উত্তরটা পাওয়া যাবে। ওপেনকোলা নামে একটি কোম্পানি পৃথিবীব্যাপি চুটিয়ে ব্যবসা করেছে; তাদের ফর্মুলা ছিল উন্মুক্ত। লিনাক্সের নাম আমরা অনেকেই শুনেছি। লিনাক্স ব্যবহার করে রেডহ্যাট কিংবা ফেডোরা অনেক ব্যবসা করছে।
পৃথিবীতে উন্মুক্ত সোর্স বা মুক্ত সোর্স বলে একটি আন্দোলন শুরু হয়েছে খুব বেশি দিন হয় নি। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য হচ্ছে, জ্ঞানের মূল বিষয়টি সবার মধ্যে উন্মুক্ত রাখা যাতে কোনো মানুষ তার প্রার্থিত জ্ঞান থেকে বঞ্চিত না থাকে। চাইলে সেই উন্মুক্ত জ্ঞানকে কাস্টোমাইজ করে প্রত্যেকে তা নিজের মতো করে ব্যবহার করতে পারবে, চাইলে একে আরও উন্নত রূপ দিয়ে বিক্রি করতে পারবে। সুতরাং ব্যবসা করার ক্ষেত্রে মুক্ত সোর্স প্রকৃতপক্ষে কোনো বাধা নয়। আজকে আমরা কম্পিউটারে যে অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহার করি, তার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহার করি। সাম্প্রতিককালে কিছু উদ্যোগী তরুণের প্রচেষ্টায় উবুন্টু, লিনাক্স মিন্ট ইত্যাদি লিনাক্সভিত্তিক অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ছে। উবুন্টু ও লিনাক্স মিন্ট দুটোই গঠিত হয়েছে উন্মুক্ত সোর্সের কাজের ওপর ভিত্তি করে। এগুলো যে কেউ চাইলেই বিনামূল্যে ব্যবহার করতে পারে। অপরদিকে, ওই একই উন্মুক্ত সোর্স থেকে রেডহ্যাট লিনাক্স বা ফেডোরার মতো অপারেটিং সিস্টেমগুলো জন্ম নিয়েছে যেগুলো লিনাক্স উন্মুক্ত সোর্স ব্যবহার করেই ব্যবসা করছে। আমরা ইন্টারনেট ব্রাউজার হিসেবে ব্যবহার করছি ইন্টারনেট এক্সপ্লোরার, মজিলা ফায়ারফক্স কিংবা গুগল ক্রোম; মোবাইলে অপেরা মিনি। একমাত্র ইন্টারনেট এক্সপ্লোরার ছাড়া বাকিগুলো পুরোপুরি মুক্ত সোর্স না হলেও সেগুলোর অনেককিছু মুক্ত সোর্সের ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। তারা কিন্তু কম ব্যবসা করছে না। আজকে আমাদের হাতে হাতে স্মার্টফোন, যার অধিকাংশ চলছে অ্যান্ড্রয়েডে। এই অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেমটি উন্মুক্ত। যে কেউ চাইলেই এটা ব্যবহার করতে পারে, আর উন্মুক্ত বলেই স্মার্টফোনের দাম আমাদের হাতের নাগালে। অথচ ভেবে দেখুন, আগেকার ব্ল্যাকবেরি ফোনের কথা! আমাদের কয়জনের সামর্থ্য আছে ব্ল্যাকবেরি কেনার? সবচেয়ে উদাহরণ দিই, আমাদের নিজের দেশের। বাংলায় লেখার সফটওয়্যার হিসেবে আমরা এতোদিন টাকা দিয়ে কিনে বিজয় সফটওয়্যার কিনে ব্যবহার করেছি, সেখানে আমাদের সবাইকে একটি ফিক্সড কি-বোর্ড লে-আউট ব্যবহার করা শিখতে হয়েছে। এখন সহজেই এবং বিনামূল্যে অভ্র ব্যবহার করতে পারছি। শুধু তাই না, চাইলে আমরা নিজেরা নিজেদের মতো করে কি-বোর্ড লে-আউটও তৈরি করে নিতে পারি। এখন এগুলোর সবকিছুই যদি কিনতে হতো আমাদেরকে, তাহলে আমরা কতোটুকু এগুতে পারতাম? আজকে যারা জ্ঞান কুক্ষিগত করে রাখে, আকাশচুম্বী দাম রেখে জ্ঞানকে আমাদের নাগালের বাইরে রাখে, তারাই আমাদেরকে পাইরেসির সঙ্গে জড়িত বলে গালাগাল করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীকে ইংরেজি নামিদামি বই ‘অবৈধভাবে’ ফটোকপি করতে হয়, কারণ তা না হলে সে জ্ঞানার্জন থেকে বঞ্চিত হবে। বইয়ের দাম নাগালের বাইরে রেখে জ্ঞানার্জনের জন্য ফটোকপি করার সংস্কৃতিকে অবৈধ বলার কোনো মানে দেখি না।
সুতরাং উন্মুক্ত সোর্স কিংবা জ্ঞানকে উন্মুক্ত করার কাজে ব্যবহার করলে যে মুনাফা নষ্ট হয়ে যাবে, বিষয়টি সত্য নয়। বরং এর সঙ্গে সামাজিক দায়বদ্ধতার বিষয়টিও নানাভাবে যুক্ত। ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বী কিংবা অন্য সব ক্ষেত্রের কথা বাদ দিলাম, জ্ঞানব্যবসার যে শাখাটি সরাসরি শিক্ষার সঙ্গে জড়িত, অর্থাৎ বই প্রকাশ ও বই বিক্রি, সেখানে জ্ঞানব্যবসা চলছে কোন কৌশলে? সাধারণত শিক্ষার্থীরা বই কিনে পড়ালেখা করে; কিন্তু যে বইগুলো সহজে পাওয়া যায় না, কিংবা দাম অনেক বেশি, শিক্ষার্থীদের সেগুলো ফটোকপি করে পড়তে হয় কিংবা একটি বই ভাগাভাগি করে পড়তে হয়। আইনগত দিক বিবেচনা করলে কপিরাইট বা গ্রন্থস্বত্বকৃত বই ফটোকপি করে পড়া মানা; কিন্তু বাস্তবতা বিচারে শিক্ষার্থীদের এটা করতে হয়। আমাদের লাইব্রেরিগুলোও একই কারণে শিক্ষার্থীদের জন্য পর্যাপ্ত বই সরবরাহ করতে পারে না। এখন আমরা যদি সব ধরনের আইন যথাযথভাবে মেনে চলতে যাই, তাহলে পড়ালেখাটাই বন্ধ হয়ে যায়। কিংবা বিদেশি বই অনুবাদের কথাই বলা যায়। জ্ঞানের নানা শাখায় প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ভাষার বা বিভিন্ন দেশের মানুষ বই লিখছেন, লিখছেন জার্নাল পেপার কিংবা আরও নানা ধরনের প্রতিবেদন। এর অধিকাংশই নানা ধরনের নিয়মের বেড়াজালে আবদ্ধ, চাইলেই কেউ সেগুলো অনুবাদ করে প্রকাশ করতে পারে না। অথচ জ্ঞানের নানা বিষয়ে জানতে হলে অনুবাদ একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। অনুবাদের জন্য আলাদা করে অনুমতি নিতে হয়, যেখানে প্রকাশকরা অর্থের বিনিময় ছাড়া অনুবাদের অনুমতি দিতে চান না। একই ধরনের কথা প্রযোজ্য, জার্নাল পেপারের ক্ষেত্রেও। অনেক জার্নাল কর্তৃপক্ষ তাদের পুরনো সংখ্যাগুলো বিনামূল্যেই পড়ার সুযোগ দিয়ে থাকে, কিন্তু নতুনগুলো পড়তে গেলে অর্থ খরচ করা ছাড়া উপায় নেই। অবশ্য দিন দিন এই ধারা পাল্টাচ্ছে। আজকাল অনেকেই কপিরাইট আন্দোলনের বদলে নামছেন কপিলেফট আন্দোলনে। জ্ঞানের বিষয়বস্তু নিয়ে যারা বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা করছেন, তাদের অনেকের মধ্যে অন্তত কিছুদিনের পুরনো বিষয়গুলো উন্মুক্ত করার একটি ধারা চালু হয়েছে। আবার একইসঙ্গে নতুন নতুন জ্ঞানকে কীভাবে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কুক্ষিগত করে রাখা যায়, তার কলাকৌশলও প্রণয়ন হচ্ছে জোরেশোরেই। সাম্প্রতিক SOPA (Stop Online Piracy Act; বিস্তারিত দেখুন এখানে: http://en.wikipedia.org/wiki/Stop_Online_Piracy_Act) এবং PIPA ((Preventing Real Online Threats to Economic Creativity and Theft of Intellectual Property Act; বিস্তারিত দেখুন এখানে: http://en.wikipedia.org/wiki/PROTECT_IP_Act) আন্দোলনের কথা নিশ্চয়ই মনে আছে অনেকের। এই আইনটি জ্ঞানের প্রবাহের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক অবস্থার এতোটাই বিরোধী ছিল যে, গুগল, উইকিপিডিয়া, ফেসবুকসহ জায়ান্টরাও এর প্রতিবাদে নামতে বাধ্য হয়েছিল।
শিক্ষার্থীরা শিক্ষা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত থাকবে, তাদের নিজস্ব দাবিদাওয়া আদায়ে সচেষ্ট থাকবে- এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে, শিক্ষা আন্দোলন এখন আর সরলরৈখিক পর্যায়ে নেই। সেখানে নানা গলিঘুঁপচি জন্ম নিয়েছে, প্রতিনিয়ত বের হচ্ছে নানা ধরনের কৌশল। এই মুক্তবাজার অর্থনীতিতে যেখানে সবকিছুকেই পণ্য হিসেবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিটি দিনকে দিন জোরালো হচ্ছে, সেখানে শিক্ষা আন্দোলনকেও বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে বহুমাত্রিক উপায়ে মোকাবিলা করতে হবে। না হলে এক আন্দোলনের ফাঁকে জন্ম নিবে হরেক রকম কালাকানুন, যেগুলো আদতে শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধেই অবস্থান নেবে। দরিদ্র মানুষের সন্তানদের পড়ালেখা প্রতিনিয়ত কঠিনতর হয়ে পড়ছে। যে বিষয়গুলো আজকে আপাতত গুরুত্ব পাচ্ছে না, সেগুলোই একদিন নিয়ামক হবে এই পৃথিবীর। সুতরাং যারা শিক্ষার সঙ্গে জড়িত, যারা শিক্ষাকে মানুষের একটি মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে দেখতে চান, তাদের সবাইকে সদর রাস্তা চেনার পাশাপাশি অলিগলি এমনি বাড়ির বারান্দাটুকুও চিনতে হবে। ব্যবসা আদতে কোনো নিয়ম মানে না, নিজেকে সুরক্ষার জন্য কিছু নিয়ম তৈরি করে নেয় মাত্র। এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে ব্যবসার অনেক নিয়মকানুনকে উদারনৈতিক মনে হলেও দিনশেষে ব্যবসা তার নিজস্ব রীতিপদ্ধতির বাইরে যাবে না। যে কোনো অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে এই মূলটুকু বিবেচনায় নেয়া উচিত।
আজকে যে উন্মুক্ত জ্ঞানের আন্দোলন, সীমিত পরিসরে হলেও, গড়ে উঠছে বিশ্বব্যাপী, তার সঙ্গে একাত্ম হতে হবে আমাদের শিক্ষার্থীদেরও। জোরালোভাবে দাবি আদায়ের পথগুলোতে অবস্থান নিতে হবে জ্ঞানব্যবসার বিরুদ্ধে। জ্ঞান সবার মধ্যে প্রবাহিত করার বিষয়, একে কুক্ষিগত করার কোনো সুযোগ নেই, এবং সেই সুযোগ তৈরি করাও যাবে না। এই বিষয়টুকু সামনে রেখে আজকের শিক্ষার্থীরা আগামী দিনের উন্মুক্ত জ্ঞান অর্জনের নিশ্চয়তার নিয়ামক হবেন, এইটুকু আশা করতে চাই।
লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন-এর ২০১৪ সালের একুশের সংকলন জয়ধ্বনিতে।