বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তি বিকাশের এই সময়টিতে একটি বিষয় সত্যিই খুব ভালো লাগে। ফেসবুক বলুন, ব্লগ কিংবা অন্যান্য ইন্টারনেটভিত্তিক প্লাটফর্মগুলোতে আজকাল মানুষজন নানা বিষয়ে নিজস্ব মত ব্যক্ত করছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এগুলো হয়তো বিশেষায়িত মত নয়; কিন্তু বিভিন্ন বিষয়ে প্রত্যেক মানুষের যে নিজস্ব চিন্তাধারা আছে এবং সেগুলো বৈচিত্র্যময়ও বটে— তা বেশ উপলব্ধি করা যায়।
মতপ্রকাশের এ চিত্র একেবারেই সাম্প্রতিক এবং দিন দিন তা কার্যকর হয়ে উঠছে। একসময় আমরা পত্রিকার পাতা কিংবা রেডিও-টেলিভিশনে বিশেষজ্ঞদের একতরফা মতামত শুনতাম, সেখানে অন্যদের প্রবেশাধিকার ছিল না। ইন্টারনেটের উন্মুক্ত বিশ্বে মানুষের স্বাধীন মতামত ধীরে হলেও রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণী ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলছে।
এসব বিষয়ের একটি হচ্ছে শিক্ষা। গত কয়েক মাসে ইন্টারনেটের বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে শিক্ষা-বিষয়ে মানুষজনের (বিশেষত তরুণ-যুবকদের) যেসব মন্তব্য-অভিমত বা পর্যালোচনা দেখেছি, তাতে মনে হয়েছে বর্তমান সময়ের শিক্ষাব্যবস্থার নানা দিক নিয়ে সাধারণ মানুষ চিন্তিত। প্রশ্নপত্র ফাঁস থেকে শুরু করে শিক্ষার মান— সব বিষয়েই মানুষ এখন নিজ নিজ বক্তব্য জানাচ্ছে এবং ক্ষেত্রবিশেষে সরকারও সাধারণের বক্তব্য শোনায় আগ্রহী হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি প্রশ্নপত্র ফাঁসরোধে সরকার সবার মতামত চেয়েছে। আশা করি, যারা এসব বিষয় নিয়ে ভাবেন, তারা সেখানে তাদের ভাবনাগুলো জানাবেন এবং নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়া এভাবেই একপাক্ষিক না হয়ে বহুপাক্ষিক হয়ে উঠবে।
আমাদের দেশে শিক্ষার যেসব বিষয় হালে মূল আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে, তার একটি হচ্ছে বর্তমান পরীক্ষাব্যবস্থা। বিশেষত এতগুলো পাবলিক পরীক্ষার আদৌ প্রয়োজন কিনা— এ আলোচনা হচ্ছে নানা জায়গায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আগ পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের চারটি পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হচ্ছে— পঞ্চম শ্রেণির পর পিএসসি, অষ্টম শ্রেণি শেষে জেএসসি, দশম শ্রেণির পর এসএসসি এবং দ্বাদশ শ্রেণির পর এইচএসসি। স্বল্পসময়ে এতগুলো পরীক্ষা শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধিতে কতটুকু ভূমিকা পালন করছে তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ রয়েছে। তাছাড়া পরীক্ষা কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীদের পড়াশুনার চাপ, তাদের মানসিক বিকাশে পরীক্ষার প্রভাব এবং সর্বোপরি গোটা পড়ালেখার চর্চাই পরীক্ষাকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে কিনা— সেগুলোও ভাবা জরুরি হয়ে পড়েছে।
পরীক্ষা-পদ্ধতি নিয়ে আমাদের অনেকেরই কিছু ভুল ধারণা রয়েছে। এর একটি হল, পরীক্ষাকে আমরা পড়ালেখা শেষের সমাপনী প্রক্রিয়া হিসেবে দেখি। এটি আংশিকভাবে ঠিক। পরীক্ষার মূল উদ্দেশ্য দুটো— শিক্ষার্থীর বর্তমান অবস্থা যাচাই করা এবং সে অনুযায়ী তাকে ফিডব্যাক প্রদান। আমরা শুধু প্রথম অংশটার ওপরই জোর দিয়ে যাচ্ছি।
অনেকে হয়তো বলতে পারেন, বিদ্যালয়ে তো ষান্মাসিক বা অন্যান্য পরীক্ষাও হয়! হয়, কিন্তু তার কয়টিতে শিক্ষার্থীদেরকে ফিডব্যাক দেওয়া হয়? আদৌ দেওয়া হয় কি? বিদ্যালয়ে ছয় মাস বা নয় মাস পর যেসব পরীক্ষা হয়, সেগুলোও মূলত বার্ষিক পরীক্ষার আদলেই নেওয়া হয়। কার্যকর ফিডব্যাক প্রদান করে শিক্ষার্থীদের ভুলগুলো শুধরে দেওয়া এবং শুদ্ধ উত্তরের জন্য প্রশংসা করার বিষয়গুলো প্রায়ই অনুপস্থিত। যে গুটিকতক বিদ্যালয় ফিডব্যাক প্রদানের কাজগুলো করে তাদের সংখ্যা এতই কম যে, এগুলো মূলধারার আলোচনাতে না আনাই ভালো।
এখানেই মূল্যায়নভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থার প্রসঙ্গটি আসে। শিক্ষক যখন বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের পড়ান, তখন শিক্ষার্থী কতটুকু শিখে বা না শিখে, তা সবচেয়ে ভালো জানেন সংশ্লিষ্ট শিক্ষক। তিনি এটাও জানেন— ওই শিক্ষার্থী পড়ালেখার বাইরে আর কোন কোন বিষয়ে দক্ষ; কোথায় কোথায় তার আগ্রহ কিংবা যোগ্যতা রয়েছে। এগুলোর মূল্যায়ন কিন্তু হয় না! না হওয়ার বড় কারণ হচ্ছে পাবলিক পরীক্ষাসমূহে এসবের স্থান নেই। আর আমরাও পাবলিক পরীক্ষায় যেসব যোগ্যতা বা দক্ষতা যাচাই করা হয়, সেগুলোর বাইরে অন্য যোগ্যতার মর্যাদা দিই না ঠিকমতো।
উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। বিদ্যালয়ের পড়ালেখায় শিশুর ভাষাগত দক্ষতা বাড়ে। কিন্তু পাবলিক পরীক্ষায় যে ধরনের প্রশ্ন আসে, সেখানে ভাষার চারটি দক্ষতার (যেমন, শোনা, বলা, পড়া, লেখা) মধ্যে মূলত লেখার দক্ষতারই পরিমাপ করা হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে পড়ার দক্ষতাও মূল্যায়িত হয়। কিন্তু শোনা বা বলার দক্ষতার মূল্যায়ন হয় না। পাবলিক পরীক্ষার কলেবর বিবেচনায় সবগুলো দক্ষতার মূল্যায়ন সম্ভবও নয়। কিন্তু একজন শিক্ষক জানেন, তাঁর ক্লাসের কোন শিক্ষার্থীটি লিখতে না পারলেও ভালো আবৃত্তি করতে পারে। কিংবা কোন শিক্ষার্থী মুখে মুখেই অনেক প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে, যদিও তার হাতের লেখা ততটা ভালো নয়।
পাবলিক পরীক্ষায় ভাষার চারটি দক্ষতার (যেমন, শোনা, বলা, পড়া, লেখা) মধ্যে মূলত লেখার দক্ষতারই পরিমাপ করা হয়
অথচ এগুলোও বিবেচ্য বিষয় হওয়া উচিত। উপরে যে কারণগুলো বলা হল, সেগুলো তো আছেই; তার সঙ্গে আরও কিছু বক্তব্য যোগ করা যায়। আমাদের দেশের প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাক্রম হচ্ছে প্রান্তিক যোগ্যতা-নির্ভর (terminal competency)। শিক্ষা ও প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের উপর ভিত্তি করে প্রাথমিক স্তরের জন্য বেশ কিছু প্রান্তিক যোগ্যতা নির্ধারণ করা আছে। এগুলো ভেঙে আবার প্রতিটি বিষয়ের জন্য বিষয়ভিত্তিক অর্জন উপযোগী যোগ্যতা (subject-wise attainable competencies) এবং শ্রেণিভিত্তিক অর্জন উপযোগী যোগ্যতা (class-wise attainable competencies) নির্ধারণ করা রয়েছে।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড বা এনসিটিবি এগুলো নির্ধারণ করেছে যার আলোকে প্রাথমিক স্তরের জন্য পাঠ্যপুস্তকসমূহ প্রণয়ন করা হয়েছে। ধরে নেওয়া হয় যে, একটি শ্রেণির পড়ালেখা শেষ করার পর শিক্ষার্থীরা ওই শ্রেণির যোগ্যতাসমূহ অর্জন করবে এবং পঞ্চম শ্রেণি শেষ করার পর তারা সবগুলো অর্জন উপযোগী ও প্রান্তিক যোগ্যতা অর্জন করবে।
এখন শিক্ষার্থী এসব যোগ্যতা অর্জন করছে কিনা, তা কীভাবে বুঝা যাবে? আমাদের পরীক্ষা পদ্ধতি তো এমন নয় যে, সেগুলোর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের এসব যোগ্যতা পরিমাপ করা হচ্ছে! বিশেষত পাবলিক পরীক্ষা তো নয়ই! একই সঙ্গে সবগুলো যোগ্যতাই যে পরিমাপ করতে হবে, তা কিন্তু বলা হচ্ছে না— সেটা খুব দুরুহ ব্যাপার। কিন্তু প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার্থী পাঁচ বছরে কী শিখল বা না শিখল, তার হিসাব কীভাবে বের করা যাবে?
উদাহরণস্বরূপ, প্রথম শ্রেণির জন্য একটি বাংলার যোগ্যতা হচ্ছে— “পরিচয়মূলক কথোপকথনে অংশগ্রহণ করতে ও বর্ণনা করতে পারবে” [১]। এই যোগ্যতা কীভাবে যাচাই করা হবে? পড়ালেখার সমস্ত টার্গেট যদি পাবলিক পরীক্ষার দিকে যায়, তাহলে কি বিদ্যালয়ের পরীক্ষায় শিক্ষকরা তাদের শিক্ষার্থীদের এসব যোগ্যতা আদৌ পরিমাপ করতে উৎসাহ বোধ করবেন?
এটা প্রাথমিকের উদাহরণ। মাধ্যমিকের জন্যও এমন উদাহরণ দেওয়া যাবে। মূল বক্তব্য হচ্ছে, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা দিন দিন পরীক্ষানির্ভর হয়ে যাচ্ছে এবং এসব পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের কার্যকর ফিডব্যাক প্রদানের ব্যবস্থা নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আগ পর্যন্ত একসময় পাবলিক পরীক্ষা ছিল দুটো— এসএসসি ও এইচএসসি। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির বৃত্তি পরীক্ষা দিত শুধু ‘মেধাবী’ শিক্ষার্থীরা। এই দুটো শ্রেণিতে পাবলিক পরীক্ষা চালুর পেছনে বড় যুক্তি হচ্ছে, মেধাবী-অমেধাবী নামে শিক্ষার্থীদের আগে যেভাবে ভাগ করা হত, এই পরীক্ষা চালুর ফলে সেটা আর থাকবে না। সবাই পরীক্ষা দিবে, ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে বৃত্তি দেওয়া হবে।
মনে পড়ে, প্রথমবার যখন প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা চালু হল, তখন এটি নিয়ে অনেকেই বিরূপ মন্তব্য করেছিলেন। কিন্তু সচলায়তন ব্লগে এই পরীক্ষার নেতিবাচক দিকসমূহ তুলে ধরার পাশাপাশি ইতিবাচক দিক তুলে ধরতে গিয়ে লিখেছিলাম–
বৃত্তি পরীক্ষার ফলাফলের সঙ্গে যেহেতু বিদ্যালয়ের ভৌত সুবিধা ও সম্মান জড়িত, তাই চতুর্থ শ্রেণি বা পঞ্চম শ্রেণির শুরু থেকেই শিক্ষকরা বাছাইকৃত শিক্ষার্থীদের প্রতি আলাদা মনোযোগ দিতেন। এতে অন্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যে বৈষম্য সৃষ্টি হত, তা কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রবলতর রূপ ধারণ করত বলে জানা গেছে। কোথাও কোথাও সব শিক্ষার্থীর জন্য নির্দিষ্টকৃত কার্যক্রম বাদ দিয়ে বৃত্তি কোচিংকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হত। এতে দেখা যায়, যারা ভালো শিক্ষার্থী, তাদের সযত্নে বিকশিত করে তোলা হলেও দুর্বলরা অবহেলিতই থাকছে— যদিও হওয়ার কথা ছিল উল্টোটা [২]।
প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা এসবের উল্টোপথে দাঁড়িয়ে ক্লাসের সকল শিক্ষার্থীকে সমভাবে গড়ে তুলবে, এই আশাবাদ রেখেছিলাম সেদিন। সেটা কতটা অর্জিত হয়েছে, তার উত্তর বের করা প্রয়োজন।
সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, পাবলিক পরীক্ষাসমূহ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় পরীক্ষানির্ভর সংস্কৃতিই দিন দিন গড়ে তুলছে। এতে শিক্ষার্থীরা কতটুকু শিখল তার চেয়ে বড় সূচক হয়ে দাঁড়াচ্ছে, কত শতাংশ পাশ করল কিংবা কোন গ্রেড পেল সেই বিষয়টি। প্রত্যেক শিক্ষার্থীই পরীক্ষায় পাশ করবে এবং ভালো ফল করবে— এই প্রত্যয় নিয়েই তারা পরীক্ষার হলে বসে কিংবা শিক্ষক ও তাদের পিতামাতা তাদের পরীক্ষা দিতে পাঠান। কিন্তু শিক্ষার্থীদের কতটুকু শেখার কথা আর তারা কতটুকু শিখছে তা কে নিশ্চিত করবে?
পাবলিক পরীক্ষাই যদি আমাদের আলটিমেট গন্তব্য হয়, তাহলে বিদ্যালয়ের সমস্ত কর্মকাণ্ডই হয়ে যাবে পরীক্ষাভিত্তিক, যথাযথভাবে শেখার বিষয়টি সেখানে স্বভাবতই গুরুত্ব কম পাবে। তাছাড়া কার্যকর মূল্যায়ন ও ফিডব্যাকের মাধ্যমে ভুলত্রুটি শুধরে যেভাবে শিক্ষার্থীদের পড়া আত্মস্থ করতে হয়, সেই প্রক্রিয়ার বদলে মুখস্থ করে বেশি নম্বর পেয়ে জিপিএ ৫ বাড়ানোর প্রতিযোগিতাই ইতোমধ্যে মূখ্য হয়ে উঠেছে। এ অবস্থায় পাবলিক পরীক্ষার বোঝা কমিয়ে বরং কার্যকর মূল্যায়নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শেখার বিষয়টি নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
তথ্যসূত্র:
[১] আবশ্যকীয় শিখনক্রম, বিষয়: বাংলা, প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাক্রম ২০১২, ঢাকা : জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড। ডাউনলোড লিংক: http://www.bn.bdeduarticle.com/%E0%A6%9C%E0%A6%BE%E0%A6%A4%E0%A7%80%E0%A7%9F-%E0%A6%B6%E0%A6%BF%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%B7%E0%A6%BE%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%AE-2/
২] সমাপনী পরীক্ষা: কিছু প্রশ্ন ও প্রস্তাব, সচলায়তন ব্লগ, ২৩.১১.২০০৯। লিংক: http://www.sachalayatan.com/goutam/28800
* লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ-এর মতামত বিভাগে ৩১ আগস্ট ২০১৪ তারিখে।