এ বছর অর্থাৎ ২০১৪ সালে বাংলাদেশ নিরক্ষরতামুক্ত হওয়ার কথা ছিল; কিন্তু হয়নি। ৮ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবসের আগের দিন সংবাদ সম্মেলনে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান জানালেন— বর্তমানে বাংলাদেশে সাক্ষরতার হার ৬৫ শতাংশ। তার মানে আরও ৩৫ শতাংশ মানুষের সাক্ষর হতে বাকি। মজার ব্যাপার হল, মাত্র এক বছর আগে ২০১৩ সালে তখনকার প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী আফছারুল আমীন জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশে সাক্ষরতার হার ৭১ শতাংশ। এক বছরে সাক্ষরতা ছয় শতাংশ হারে কমে গেল?
বাস্তবতার নানা ফ্যাক্টর হিসাব করলে কমতেই পারে। সাক্ষরতা সাঁতার কাটা বা সাইকেল চালানোর মতো এমন কোনো দক্ষতা নয় যে একবার অর্জন করলে তা সারাজীবনই থাকবে। প্রকৃতপক্ষে বহু মানুষই প্রথম জীবনে কিছু পড়ালেখার পর সারাজীবন আর পড়ালেখা নিয়ে মাথা ঘামায় না। অনেকে প্রারম্ভিক পড়ালেখার পর চর্চা না করায় শেষ দিকে তা ভুলে যায়। সুতরাং শিক্ষা-প্রক্রিয়ার সঙ্গে অব্যাহতভাবে জড়িয়ে না থাকলে সাক্ষরতার হার বাড়া-কমা স্বাভাবিক ব্যাপার।
কিন্তু আমাদের দেশে বছর বছর সাক্ষরতার হার যেভাবে বাড়ে-কমে, তাতে প্রকৃতপক্ষে কত শতাংশ মানুষ সাক্ষর তা জানাই কঠিন হয়ে পড়ছে। একদিকে যেমন সরকার পরিবর্তনের ফলে সাক্ষরতার হারে পরিবর্তন হয়, তেমনি একই সরকারের আমলে বিভিন্ন বছরেও এ হারে পরিবর্তন দেখা যায়।
আর পরিবর্তনগুলোও এমন যে, একটির সঙ্গে আরেকটির যোগসূত্র অনেক সময় খুঁজে পাওয়া যায় না। সাক্ষরতার হার কখনও বেড়ে যাচ্ছে এক লাফে, কখনও-বা যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়াই নিচে নেমে যাচ্ছে। এই যেমন, গতবারের চেয়ে এবার সাক্ষরতার হার কমার দৃশ্যত কোনো কারণ নেই; কিন্তু যেহেতু মন্ত্রী জানিয়েছেন, সুতরাং একেই প্রামাণ্য হিসেবে ধরে নিতে হবে।
শিক্ষা-প্রক্রিয়ার সঙ্গে অব্যাহতভাবে জড়িয়ে না থাকলে সাক্ষরতার হার বাড়া-কমা স্বাভাবিক ব্যাপার
প্রামাণ্য ধরে নেওয়ার ক্ষেত্রেও রয়েছে আরেক সমস্যা। বাংলাদেশে সাক্ষরতার হার নির্ণয়ে সর্বশেষ বড় ধরনের খানা জরিপ করেছে বাংলাদেশ সরকারেরই একটি প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিকস বা বিবিএস। তাদের ২০১০ সালের হিসাব অনুসারে সাক্ষরতার হার ছিল ৫৯.৮২ শতাংশ। প্রতি বছর যে সংখ্যক মানুষ সাক্ষর হয়, তাতে বর্তমানে এ হার ৬৫ শতাংশ বা এর কাছাকাছিই হওয়ার কথা। সাক্ষরতার হার বৃদ্ধিতে উল্লম্ফন হলে তা ৭০-এও পৌঁছুতে পারে। আপত্তি সেখানে নয়, কিন্তু কোন জায়গায় আমরা আছি সেটা তো যুক্তিসঙ্গত পদ্ধতিতে ঠিক করতে হবে! এ সব ক্ষেত্রে ইচ্ছেমতো সংখ্যা বসানোর তো সুযোগ নেই!
সরকারের একাধিক সংস্থা এসব বিষয়ে জরিপ করে। একটির জরিপের ফলাফলের সঙ্গে আরেকটির ফলাফলের ভিন্নতা হয়। কেন? মেথডোলজির কারণে?
অভিজ্ঞতা থেকে যতটুকু জানি, প্রতিটি সংস্থা মোটামুটি একই ধরনের মেথডোলজি অনুসরণ করে। সাক্ষরতা বিষয়ে সব ক’টি খাটাখাটুনি না করে কোনো একটি সংস্থা নিয়মিত বিরতিতে একটি নির্দিষ্ট মেথডোলজি অনুসরণ করে জরিপ করবে— সরকার কি এই সিদ্ধান্ত নিতে পারে না? সে ক্ষেত্রে বিভ্রান্তির হার অনেকটাই কমানো সম্ভব।
অন্যদিকে বেসরকারি সংস্থাগুলো সাক্ষরতার যে হিসাব করে তাতে দেখা যায়, বর্তমানে সাক্ষরতার হার ৫৭-৫৮ শতাংশ। ৮ সেপ্টেম্বরের একটি দৈনিক পত্রিকায় গণসাক্ষরতা অভিযানের প্রধান ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরীও একই ধরনের তথ্য দিয়েছেন। উল্লেখ্য, গণসাক্ষরতা অভিযান বাংলাদেশে শিক্ষা নিয়ে যে সমস্ত বেসরকারি সংস্থা কাজ করে, তাদের একটি বড় নেটওয়ার্ক কোঅর্ডিনেট করে। তাদের মেথডোলজি ও সরকারের মেথডোলজি সবসময় এক রকম হয় না। এ অবস্থায় সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো একেক সময় একেক ধরনের হিসাব দিচ্ছে। কোনটিকে আমরা প্রামাণ্য ধরে নেব?
জটিলতা রয়েছে সাক্ষরতার তথ্য কীভাবে আনা হয় সে প্রক্রিয়াতেও। সাধারণত এ ধরনের জরিপে দেখা যায়, জরিপকারীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে জানতে চান, এই খানার সদস্য কতজন এবং তাদের মধ্যে কতজন লেখাপড়া করতে পারে। একে বলা হয় ‘সেলফ-রিপোর্টেড’ বা স্ব-মূল্যায়িত সাক্ষরতা। সরকারি জরিপকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ এই সেলফ-রিপোর্টেড সাক্ষরতার তথ্য সংগ্রহ করে।
দেখা যায়, যারা নিরক্ষর, তারাও এই প্রক্রিয়ায় অনেক সময় সাক্ষরতার হিসাবে চলে আসে। কেউ তো আর ইচ্ছে করে নিজেকে নিরক্ষর বলতে চায় না! বিশেষ করে যারা প্রথম জীবনে বিদ্যালয়ে গিয়েছিলে, তারা লেখাপড়া ভুলে গেলেও নিজেকে সাক্ষর দাবি করতেই বেশি পছন্দ করেন। তারা সত্যিকার অর্থেই সাক্ষর কি-না এ পরীক্ষা নেওয়া হলে নিশ্চিতভাবেই সাক্ষরতার হার কম হত।
অন্যদিকে সাক্ষরতার সংজ্ঞায় রয়েছে ধোঁয়াশা। সব প্রতিষ্ঠান একইভাবে সাক্ষরতার সংজ্ঞা ব্যবহার করছে না। একসময় শুধু পড়তে ও লিখতে পারাই সাক্ষরতা মনে করা হলেও, এখন এর সঙ্গে আরও কিছু বিষয় যুক্ত হয়েছে। ইউনেস্কো যে সংজ্ঞা দিচ্ছে তাতে বলা হয়, যে কোনো ভাষায় পড়তে, বুঝতে ও লিখতে পারা এবং দৈনন্দিন জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় গাণিতিক দক্ষতা থাকলেই কেবল একজনকে সাক্ষর বলা যাবে। এখন এই সংজ্ঞানুসারে সাক্ষরতা হিসাব করলে সত্যিকার অর্থেই কতজন সাক্ষর, তা বের করা একটি ভিন্নতর গবেষণার কাজ।
সাক্ষরতা নিয়ে ২০০২ সালে একটা ব্যতিক্রমী কাজ করেছিল এডুকেশন ওয়াচ টিম। তারা ইউনেস্কোর এই সংজ্ঞা ভিত্তি ধরে সাক্ষরতা জরিপ চালিয়েছিল এবং সাক্ষরতাকে তারা চার ভাগে ভাগ করেছিল— অ-সাক্ষর বা নিরক্ষর, প্রাক-সাক্ষর, প্রারম্ভিক স্তরের সাক্ষর ও উচ্চতর স্তরের সাক্ষর।
প্রাক-সাক্ষরের সংজ্ঞা ছিল এ রকম– “কিছু শব্দ পড়তে ও লিখতে পারা, ন্যূনতম গণনার দক্ষতা অর্জন এবং দৈনন্দিন জীবনে এই দক্ষতাগুলো খুবই সীমিতভাবে ব্যবহার করতে পারা।”
প্রারম্ভিক স্তরের সাক্ষরতার সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছিল এভাবে– “পরিচিত বিষয়াবলী সম্পর্কিত সহজ বাক্যসমূহ পড়তে ও লিখতে পারা, পাটিগণিতের চারটি মৌলিক নিয়মে অংক কষতে পারা এবং প্রাত্যহিক জীবনের পরিচিত পরিবেশে এই দক্ষতা ও যোগ্যতাসমূহ সীমিতভাবে ব্যবহার করতে পারা।’’
অন্যদিকে উচ্চতর স্তরে সাক্ষরতার সংজ্ঞা হিসেবে বলা হয়েছিল, “বিচিত্র বিষয়াবলী সম্পর্কিত লেখা সাবলীলভাবে পড়তে পারা, এ ধরনের বিষয়াবলী সম্পর্কে স্বচ্ছন্দে লিখতে পারা, পাটিগণিতের মৌলিক চার নিয়মে দক্ষতা লাভসহ গাণিতিক কার্যকারণ বুঝতে পারা, প্রাত্যহিক জীবনে এই দক্ষতাগুলো ব্যবহার করতে পারা এবং অধিকতর শিক্ষা গ্রহণকল্পে সামগ্রিক সাক্ষরতা দক্ষতাকে স্বাধীনভাবে প্রয়োগ করতে পারা।”
সাদা চোখে মনে হবে এডুকেশন ওয়াচ গ্রুপ কঠিনভাবে সাক্ষরতার সংজ্ঞায়ন করেছে; আসলে তা নয়। সাক্ষরতার মূল যে সংজ্ঞা, অর্থাৎ পড়তে, বুঝতে ও লিখতে পারা এবং দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োগ করার মতো গাণিতিক দক্ষতা থাকার বিষয়টি তারা ভিন্নরূপে ভাগ ভাগ করে উপস্থাপন করেছে। এই গ্রুপটি গুরুত্বপূর্ণ যে কাজটি করেছিল তা হল, তারা প্রতিনিধিত্বমূলক নমুনায়ন (representative sampling) করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে পরীক্ষা নিয়ে তবেই সাক্ষরতার হার ঘোষণা করেছিল।
২০০২ সালের পর এডুকেশন ওয়াচ গ্রুপ সাক্ষরতা নিয়ে কাজ করেনি, কিন্তু এভাবে যদি সাক্ষরতার হার বের করা যায়, তাহলে দেশে সত্যিকার অর্থে কত শতাংশ মানুষ নিরক্ষর তা বের করা সম্ভব হবে।
২.
ধরে নিচ্ছি, বাংলাদেশে এখন ৩৫ শতাংশ মানুষ নিরক্ষর। বাস্তবতা হচ্ছে, এ বছরের মধ্যে তাদের সবার সাক্ষর হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। তাহলে কবে সবাই সাক্ষর হবে? এর জন্য আমরা কতদিন সময় নেব?
বলা প্রয়োজন, সরকারি ও বেসরকারি নানা উদ্যোগের কারণে বেশ কিছুদিন ধরেই আমাদের প্রাথমিক শ্রেণিতে ভর্তির হার প্রায় শতভাগ। তারা সবাই যদি প্রাথমিক শিক্ষা যথাযথভাবে সম্পন্ন করে, তাহলে ১৫ বছরের নিচের মানুষদের সাক্ষরতা নিয়ে আলাদাভাবে চিন্তা করার দরকার নেই। প্রয়োজন ১৫ থেকে ৪৫ বছর বয়সী নিরক্ষরদের জন্য সাক্ষরতার ব্যবস্থা করা। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ এই গ্রুপের মানুষদের গুরুত্ব দিয়ে বয়স্ক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমে সাক্ষর করার কথা বলা আছে।
শিক্ষানীতি অনুসারে, ২০১০ সালে এ রকম নিরক্ষর মানুষের হার ছিল ৫১ শতাংশ। চার বছরে হয়তো বয়স্ক নিরক্ষরতার হার বেশ কিছুটা কমেছে। শিক্ষানীতিতে এক জায়গায় বলা আছে, ২০১৪ সালের মধ্যে সব প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকে সাক্ষর করে তোলা; অন্যদিকে আরেক জায়গায় বলা আছে, প্রাপ্তবয়স্ক সবাইকে সাক্ষর না করা পর্যন্ত বয়স্ক শিক্ষার কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া হবে। দেখা যাচ্ছে, বয়স্ক শিক্ষার টার্গেট অর্জনের ক্ষেত্রে শিক্ষানীতি সময়সীমা বেঁধে দিতে পারেনি।
তাহলে সব মিলিয়ে নিরক্ষরতা দূর হবে কীভাবে? এ ব্যাপারে সরকারের বলার মতো উদ্যোগ নেই। একসময় দেশে নিরক্ষরতা দূরীকরণের নামে ‘সার্বিক সাক্ষরতা আন্দোলন’ বা Total Literacy Movement চালিয়ে টাকা লুটপাটের জন্য অর্থহীন একটি আয়োজন চালানো হয়েছিল। এ ধরনের আয়োজন এ সময়ে এসে সরকার আশা করি আর করবে না। একসময় শুনেছিলাম, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের অংশগ্রহণে সরকার দেশ থেকে নিরক্ষরতা দূর করবে। তারও কোনো উদ্যোগ দেখিনি শেষ পর্যন্ত।
এমন নয় যে, দেশের সব মানুষ সাক্ষর হয়ে গেলে দেশটি রাতারাতি উন্নত হয়ে যাবে কিংবা জনজীবনে আমূল পরিবর্তন দেখা দেবে। কিন্তু কাজটি সম্পন্ন করা গেলে বিশ্বের কাছে মানমর্যাদা বাড়বে নিশ্চয়ই। যে কাজ করে সহজে সুনাম অর্জন করতে পারি, সেটি করতে অনীহা দেখাচ্ছি কেন?
এমনও তো নয় যে, কাজটি খুব কঠিন; কিংবা এটি করার জন্য নতুন কৌশল বা পদ্ধতি আবিষ্কার করতে হবে। ক্ষমতায় আসার পর ফিদেল ক্যাস্ত্রো তার দেশ কিউবাকে দ্রুত নিরক্ষরমুক্ত করেছেন। এটি বহু পুরাতন উদাহরণ। সাম্প্রতিক সময়ে বলিভিয়ার প্রেসিডেন্ট ইভো মোরালেস মাত্র তিন বছরে তার দেশকে নিরক্ষরমুক্ত করেছেন। বলিভিয়া তো খুব উন্নত দেশ নয়। তারা পারলে আমরা পারব না কেন?
আমাদের শিক্ষার্থীদের দিয়েই কাজটি করানো সম্ভব। অষ্টম শ্রেণি থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত যে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী রয়েছে আমাদের, তাদের যথাযথভাবে কাজে লাগিয়ে তিন থেকে চার বছরের মধ্যেই নিরক্ষরতা দূর করা সম্ভব। এনজিওগুলোও কাজ করতে চায় এসব বিষয়ে। তাদেরও কাজে লাগানো যাবে।
মোট কথা, সরকার আন্তরিকভাবে চাইলে নিরক্ষরমুক্ত বাংলাদেশ কিন্তু খুব দূরের পথ নয়।
* লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ-এর মতামত বিভাগে ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৪ তারিখে।