বাংলাদেশে ২০২৪ সালের নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু হয়েছে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাব্যবস্থায় বড় পরিবর্তনের মধ্যদিয়ে। এই পরিবর্তন নিয়ে হচ্ছে অনেক ধরনের আলোচনা ও সমালোচনা। শিক্ষক ও শিক্ষাবিদদের সাথে সাথে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসব নিয়ে কথা বলছেন অভিভাবক এবং বাবা-মায়েরাও।
বাংলাদেশের মাধ্যমিক পর্যায়ের নতুন এই শিক্ষাক্রম বিষয়ে এসবিএস বাংলার সঙ্গে কথা বলেছেন বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার চার্লস স্টার্ট ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি গবেষণারত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সহযোগী অধ্যাপক গৌতম রায়। দুই পর্বের এই সাক্ষাৎকারে আজ থাকছে সাক্ষাৎকারে প্রথম পর্ব। সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন তারেক নূরুল হাসান। সাক্ষাৎকারটি অডিও থেকে লিখিত আকারে রূপদান করেছেন শামস আল গালিব।
সাক্ষাৎকারের প্রথম পর্বটি শুনতে এখানে ক্লিক করুন। প্রথম পর্বটি প্রচারিত হয়েছিলে ১৯ জানুয়ারি, ২০২৪ তারিখে।
প্রথম পর্ব
তারেক নূরুল হাসান: এসবিএস বাংলায় আপনাকে স্বাগত জানাই।
গৌতম রায়: ধন্যবাদ তারেক, আমাকে এসবিএস বাংলায় আমন্ত্রণ জানানোর জন্যে।
তারেক নূরুল হাসান: আমরা জানতে পেরেছি যে, আপনি বাংলাদেশের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছেন। সেই সাথে এখন অস্ট্রেলিয়ায় পিএইচডি করছেন। আপনার গবেষণার বিষয় সম্পর্কে যদি সংক্ষেপে একটু বলেন?
গৌতম রায়: আমি অস্ট্রেলিয়ার চার্লস স্টার্ট ইউনিভার্সিটিতে এখন পিএইচডি গবেষক হিসেবে কর্মরত রয়েছি। আমি মূলত শিশুরা কীভাবে তাদের সায়েন্টিফিক লিটারেসি স্কিল ডেভেলপ করে সেই বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান করছি এবং সেটার জন্য আমি অস্ট্রেলিয়ান প্রি-স্কুল এবং প্রাইমারি স্কুলের শিশুদের প্লে-বেইজড এক্টিভিটির মাধ্যমে তারা কীভাবে তাদের সায়েন্টিফিক লিটারেসি স্কিলটা ডেভেলপ করে, সেটার অনুসন্ধান করছি।
এবং এই কাজটি করতে গিয়ে আমি তাদের স্কুল বা সেন্টারে তারা কীভাবে কাজ করে প্লে-বেইজড এক্টিভিটিজের মাধ্যমে, তাদের সাইন্টিফিক লিটারেসি স্কিলটা কীভাবে ডেভেলপ করে, সেখানে তাদের শিক্ষক বা এডুকেটর যারা আছেন তারা কী কাজ করেন, কীভাবে কাজ করেন, তাদের পারসেপশন কী, প্যারেন্টসরা বাসায় শিশুদের নিয়ে কী কাজ করেন— সবমিলে হলিস্টিক ওয়েতে আমি এই ডেভলপমেন্টটা খুঁজতে চাচ্ছি।
এবং পাশাপাশি আমি অস্ট্রেলিয়ার দুইটি গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট, একটি হচ্ছে আর্লি ইয়ার্স লার্নিং ফ্রেমওয়ার্ক এবং আরেকটি হচ্ছে অস্ট্রেলিয়ান কারিকুলাম সায়েন্স এই দুটি রিভিউ করবো এবং তারপরে সবগুলো মিলে সমন্বিতভাবে শিশুদের এই ডেভেলপমেন্ট প্রসেসটা কীভাবে হচ্ছে, সেটা আমি বের করার চেষ্টা করছি।
তারেক নূরুল হাসান: এবার মূল প্রসঙ্গে আসি। নতুন ২০২৪ শিক্ষাবর্ষ থেকে বাংলাদেশের মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন একটি শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি চালু করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আপনার অভিমত কী?
গৌতম রায়: এই প্রসঙ্গে যদি খেয়াল করেন, বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কিংবা মিডিয়াতে প্রচুর আলোচনা হচ্ছে। মোটাদাগে বলা যায় একটা মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে শিক্ষকদের মধ্যে, অভিভাবকদের মধ্যে এবং যারা শিক্ষা বিশেষজ্ঞ আছেন তাদের মধ্যে। কেউ কেউ মনে করছেন, এই নতুন শিক্ষাক্রম ভালো, আবার কেউ কেউ মনে করছেন খারাপ।
আমার একটা মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে। আমি মনে করি যে, নতুন শিক্ষাক্রমে বেশ কিছু বিষয় এসেছে যেগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ। যে ধরনের পরিবর্তনের কথা আমরা বিভিন্ন সময়ে বলি তার কিছু রিফ্লেকশন এটাতে এসেছে। উদাহরণ হিসেবে যদি বলি, আমরা সবসময় বলে এসেছি যে প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক শ্রেণিতে শিক্ষার্থীদের ওপর পরীক্ষার যে চাপ সেটি কমানো। সেই জায়গাতে দেখতে পাচ্ছি যে একটা ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে।
আবার অন্যদিকে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে এই নতুন শিক্ষাক্রমে বেশ কিছু সাবজেক্ট বা বিষয়ে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, যেগুলো আমার মতে হয়তো এখানে অতোটা দরকার নেই। আমাদের বিজ্ঞান বিষয়ে যতটুকু কনটেন্ট পূর্ববর্তী শিক্ষাক্রমে ছিল সেটি কমে এসেছে। সার্বিকভাবে আমি এভাবে বলব যে, এখানে ইতিবাচক নেতিবাচক দুটোই আছে।
কিন্তু আমি একটু সন্দিহান যে, নতুন শিক্ষাক্রম যেভাবে এখানে এসেছে এবং এটা যেভাবে ইমপ্লিমেন্ট করার কথা বলা হচ্ছে, সেটা আসলে ঠিকভাবে করা যাবে কিনা এবং একটা সময় পরে এটা আবার ব্যাকফায়ার করে কিনা বা সার্বিকভাবে নেতিবাচক একটা রেজাল্ট আমাদের কাছে নিয়ে আসে কিনা সে বিষয়ে আমার আসলে সন্দেহ আছে ।
তারেক নূরুল হাসান: তার মানে আপনি বলতে চাইছেন যে, নীতিগত সিদ্ধান্ত হিসেবে এ ব্যাপারটা ঠিক আছে কিন্তু প্রায়োগিক ক্ষেত্রে আরও কিছু করার অবকাশ মনে হয় থেকে যায়।
গৌতম রায়: আমি একটু যদি খোলাসা করে বলি, নীতিগত ব্যাপারে পুরোপুরি ঠিক আছে আমি সেটা বলবো না। কিছু কিছু বিষয় ঠিক আছে। যেমন আমি পরীক্ষার ব্যাপারটা উল্লেখ করলাম। বিশেষ করে আমি যদি মূল্যায়ন শব্দটা ব্যবহার করি তাহলে ভালো হয়, যেভাবে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হবে এটা একটা ভালো বিষয়। কিন্তু আমি সন্দিহান আসলে কয়েকটা কারণে।
প্রথম বিষয়ে আমি যদি বলি যে, কিছুদিন আগে গত ৭ তারিখে আমাদের নতুন সরকার গঠিত হয়েছে। তার আগে শিক্ষা মন্ত্রী ছিলেন দীপু মনি। এবং শিক্ষা উপমন্ত্রী যিনি ছিলেন তাঁরা মিলে এই কাজটা করেছেন। গত টার্মে সরকার ক্ষমতায় আসার পর তাঁরা বলেছিলেন যে, তাদের প্রায়োরিটি হচ্ছে আমাদের যে শিক্ষানীতি আছে সেটাকে আপডেট করা। সেই কাজটা না করে তারা আসলে সরাসরি শিক্ষাক্রমটা আপডেট করলেন। প্রশ্ন হচ্ছে যে, একটা দেশের শিক্ষাক্রম আসলে গঠিত হয় বা রচিত হয় শিক্ষানীতিকে কেন্দ্র করে। কিন্তু এখানে আমরা যেটা দেখলাম, শিক্ষানীতিকে চেঞ্জ না করে তারা আসলে শিক্ষাক্রমটাকে সরাসরি গুরুত্ব দিয়ে চেঞ্জ করছেন।
এখন আমাদের বর্তমান যে শিক্ষানীতি, যেটা গঠিত হয়েছিল ২০১০ সালে, সেটা যদি এখন পরিবর্তন করতে হয়, দেখা যাবে যে কিছুদিনের মধ্যেই শিক্ষাক্রমকেও আবার পরিবর্তন করতে হচ্ছে। নীতিগত জায়গায় আমার প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে যে, কেন শিক্ষানীতিকে পরিবর্তন না করে শিক্ষাক্রম তৈরি করা হলো? কিংবা বর্তমানে যে শিক্ষানীতি আছে সেটাকে ভিত্তি না করে কেন শিক্ষাক্রমে এই পরিবর্তনটা আনা হলো? এই বিষয়টা নিয়ে আমি আসলে ক্লিয়ার না বা আমি এটার সন্তোষজনক কোনো জবাব এখনো পাইনি।
আর দ্বিতীয় বিষয় যেটা হচ্ছে, আমরা শিক্ষাক্রমটাকে এখন যেভাবে দেখছি— আমরা আসলে একটা হাই স্পিড ট্রেইন কিনে ফেলেছি, কিন্তু হাই স্পিড ট্রেন চালানোর জন্য আমার যে পর্যাপ্ত লোকবল লাগবে, আমার যে অবকাঠামো লাগবে, রেললাইন লাগবে, রেললাইনের পাথর লাগবে, আমার যে স্টেশন লাগবে, বিদ্যুৎ লাগবে আমাদের প্রায় কোনোকিছুই নেই। তো, এই যে মূল্যায়ন পদ্ধতির কথা আমি উদাহরণ হিসেবে বললাম এই মূল্যায়ন পদ্ধতিটা ভালো। কিন্তু, এই মূল্যায়ন পদ্ধতি ঠিকভাবে ইনপ্লিমেন্ট করার জন্য সেই পরিমাণ প্রশিক্ষিত এবং নলেজেবল শিক্ষক আছে কিনা এটা কিন্তু একটা বড় প্রশ্ন।
আমরা শিক্ষাক্রমটাকে এখন যেভাবে দেখছি— আমরা আসলে একটা হাই স্পিড ট্রেইন কিনে ফেলেছি, কিন্তু হাই স্পিড ট্রেন চালানোর জন্য আমার যে পর্যাপ্ত লোকবল লাগবে, আমার যে অবকাঠামো লাগবে, রেললাইন লাগবে, রেললাইনের পাথর লাগবে, আমার যে স্টেশন লাগবে, বিদ্যুৎ লাগবে আমাদের প্রায় কোনোকিছুই নেই। তো, এই যে মূল্যায়ন পদ্ধতির কথা আমি উদাহরণ হিসেবে বললাম এই মূল্যায়ন পদ্ধতিটা ভালো। কিন্তু, এই মূল্যায়ন পদ্ধতি ঠিকভাবে ইনপ্লিমেন্ট করার জন্য সেই পরিমাণ প্রশিক্ষিত এবং নলেজেবল শিক্ষক আছে কিনা এটা কিন্তু একটা বড় প্রশ্ন।
পাশাপাশি আপনি যদি দেখেন, এই অস্ট্রেলিয়ার কথাই যদি চিন্তা করি যেখানে প্রাথমিক শ্রেণি বা প্রি-প্রাইমারিতে ৭ জন বা ১০ জন বা ১২ জন শিক্ষার্থীদের জন্য একজন করে শিক্ষক থাকেন। কিন্তু আমাদের দেশে একজন শিক্ষককে ৫০ জন বা ৬০ জন শিক্ষার্থীকে নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে। তো, এই মূল্যায়নটা যেটা শিক্ষকরা করবেন অর্থাৎ ধারাবাহিক মূল্যায়ন, তারা এটি করার জন্য প্রশিক্ষণ পেয়েছেন কিনা, এতগুলো শিশুকে তারা সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারবেন কিনা, সেটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
এবং পাশাপাশি, এখানে যে বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যেমন, জীবন ও জীবিকা, শিল্প ও সংস্কৃতি কিংবা তথ্যপ্রযুক্তি, আমি যেটা দেখতে পাচ্ছি সেটা হচ্ছে আমাদের সবকিছুকেই পাঠ্যবইয়ে ইনক্লুড করে দেওয়ার একটা প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। আমি যদি জাস্ট তথ্যপ্রযুক্তির উদাহরণ দিই, তাহলে আমাদের আসলে দরকার বিজ্ঞান ও গণিতের ভিত শক্ত করা, তথ্যপ্রযুক্তি একটা অ্যাডিশনাল কাজ হিসেবে এখানে আসতে পারে। কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তি এজ আ সাবজেক্ট আমার মনে হয় না এই পর্যায়ে এতটা গুরুত্বপূর্ণ বা আসলেও এই পর্যায়ে দরকার আছে। সব মিলে আমি আসলে বর্তমান শিক্ষাক্রমটা নিয়ে সন্দিহান।
নীতিগত জায়গাটা থেকেও আমি সন্দিহান। কেনোনা, শিক্ষানীতিটা অনুসরণ করে এটি তৈরি করা হয়নি। কেন তৈরি করা হয়নি সেটি ক্লিয়ার না। এবং যেভাবে তাঁরা ইমপ্লিমেন্ট করার কথা বলছেন, সেভাবে তারা করতে পারবেন কিনা এ বিষয়েও আমি সন্দিহান।
তারেক নূরুল হাসান: অনেক ধন্যবাদ আপনাকে প্রফেসর গৌতম রায়।
সাক্ষাৎকারের দ্বিতীয় পর্বটি শুনতে এখানে ক্লিক করুন। দ্বিতীয় পর্বটি প্রচারিত হয়েছিলো ২২ জানুয়ারি, ২০২৪ তারিখে।
দ্বিতীয় পর্ব
তারেক নূরুল হাসান: এসবিএস বাংলায় আপনাকে আবারও স্বাগত জানাই। আমরা দেখতে পেয়েছি বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিছু বিষয় নিয়ে বেশ বিতর্ক হচ্ছে। যেমন আপনি যেটা বললেন বিজ্ঞান বইয়ের কিছু সংযুক্তি নিয়ে অনেকের ইতিবাচক ও নেতিবাচক মন্তব্য করছে। অনেক প্যারেন্টস দেখলাম যে তারা আবার বেশ খুশিও এই বদলে। কিন্তু আমরা দেখছি যে, কিছু শিক্ষক বলছেন যে না এই জিনিসগুলোর জন্য হয়তো তারা এখনো প্রস্তুত না। এ প্রসঙ্গে আপনার আর কোনো মতামত আছে কিনা?
গৌতম রায়: আমার মতামত এরকম যে, আপনি যে প্যারেন্টসদের কথা বললেন, তাদের অনেকেই খুশি আবার অনেকে অখুশি। যে সকল শিক্ষকরা মনে করেন যে, শুধু পড়ালেখা বা পরীক্ষার বাইরেও তাদের সন্তানরা যাতে হাতে-কলমে কিছু কাজ করতে পারে, সে ক্ষেত্রে শিশুরা কিন্তু হাতে-কলমে কাজ করছে। তো, সেখান থেকে কিন্তু প্যারেন্টসরা খুশি।
আবার অনেক প্যারেন্টস অখুশি, অনেক শিক্ষকও অখুশি। তার কারণ হচ্ছে যে, পড়াশোনার যে ট্র্যাডিশনাল চিন্তাটা আমাদের মাথায় আছে যে শিশুরা বই পড়ব, তারা লিখবে, পরীক্ষা হবে সেই জায়গা থেকে এক ধরনের বিচ্যুতি বা একটা ভিন্ন ধরনের কাজ তারা দেখতে পাচ্ছে। এই জায়গা থেকে তারা সন্দিহান যে, এইখান থেকে তারা তাদের সন্তানের জন্য আসলেই ইতিবাচক কিছু বয়ে আনবে কিনা।
আমি একটু আগে একটা কথা বললাম যে, আমাদের একটা প্রবণতা সবকিছু পাঠ্যবই বা স্কুলের মাধ্যমে শেখানো। এই কারিকুলামের সেটার একটা রিফ্লেকশন দেখা যাচ্ছে। আমি যে একটা উদাহরণ দিলাম যে, এখানে শিল্প সংস্কৃতি জীবন ও জীবিকা অনেক কিছু আছে। বিজ্ঞানের অনেক কিছু কমে যাচ্ছে, গণিতে যেখানে হয়তো আরো কিছু দেওয়া যেতো কিংবা সামাজিক বিজ্ঞান রিলেটেড অনেক কিছু দেওয়া যেতো, কিন্তু যে বিষয়গুলো দেওয়া হচ্ছে সেটাকে আমি যদি এভাবে চিন্তা করি যে কারিকুলাম বা শিক্ষাক্রম যে শব্দটা এর সাথে আরো বেশ কিছু বিষয় জড়িত থাকে। কো-কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিজ, এক্সট্রা-কারিকুলার একটিভিটিজ, হিডেন কারিকুলাম এরকম আরো অনেক বিষয় আছে। তো কারিকুলাম এবং পাঠ্যসূচিতে কিছু বিষয় থাকবে, বিষয়ে শিক্ষকদের জন্য যে মডিউল বা গাইড লাইন সেটাতে থাকবে এবং শিক্ষকরা সমন্বিতভাবে সে বিষয়গুলো বিদ্যালয়ে বাস্তবায়ন করবেন।
শিক্ষার্থীরা কিছু বিষয়ে বই থেকে শিখবে এবং শিক্ষক বিভিন্ন অ্যাক্টিভিটিজের মাধ্যমে সেখানে সে বিষয়গুলো তাদের হাতে-কলমে শেখাবে। কিন্তু সবকিছুই যখন কারিকুলামে চলে আসে তখন সেটা নিয়ে আসলে প্রশ্ন জাগাটা স্বাভাবিক। আমাদের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে কিছু সাবজেক্ট কিছু কনটেন্ট আমরা ধরে নেই যে আসলে এটা শিক্ষার্থীদেরকে পড়তে হবে। তবে এটা যদি আমরা অস্ট্রেলিয়া, ফিনল্যান্ড যাদের উদাহরণ দেয়া হচ্ছে, অর্থাৎ আমরা যাদেরটা দেখেছি তারা অনেক কিছু কিন্তু স্কুলে পড়ছে, স্কুলে পড়ালেখা করে শিখছে। পড়ালেখাটাকে বাদ দিয়ে আসলে কিছু না। সেই জায়গা থেকে কিছু সন্দেহ অনেক অভিভাবক ও অনেক শিক্ষকের মধ্যে তৈরি হয়েছে।
তারেক নূরুল হাসান: আরেকটা বিষয় খুব সামনে চলে আসছে যে, পাঠ্যবইয়ে শিক্ষার্থীদের এলজিবিটিকিউ সম্প্রদায়ের মানুষদের প্রসঙ্গটা নিয়ে আসা নিয়ে। তাদের সম্পর্কে জানা নিয়ে শিক্ষার্থীদের চেয়ে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে এটা নিয়ে অনেক বাবা-মা তাদের আশঙ্কা প্রকাশ করছেন নানা রকম। এ প্রসঙ্গে আপনার কী মনে হয়?
গৌতম রায়: জ্বি, এটা আমি দেখেছি যে, এলজিবিটিকিউ কিংবা যৌন স্বাস্থ্য, প্রজনন স্বাস্থ্য ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। আমরা শিক্ষাকে তো আসলে পরিবার বা সমাজ থেকে আলাদা করে দেখতে পারি না। আমরা বিদ্যালয়ে যা শিখি, আমাদের রাষ্ট্রের যে আদর্শ আমাদের সংবিধানে যা আছে, আমাদের সমাজ আসলে এগুলো চিন্তা করে সবকিছু আসলে পরস্পর সম্পর্কিত।
সো, আমরা সমাজে আসলে যেভাবে চিন্তা করি, তার একটা রিফ্লেকশন এখানে দেখতে পাচ্ছি। সেই জায়গা থেকে অনেকে হয়তো মনে করছেন যে, এই বিষয়গুলো আসলে পাঠ্যবইয়ে আসা ঠিক হবে না। অনেকে আবার মনে করছেন যে, আমাদের আসলে বিভিন্ন ধরনের কনটেন্ট সম্পর্কে জানা উচিত। যেমন, যে বিষয়গুলো নিয়ে পৃথিবীতে আলোচনা হচ্ছে, যে বিষয়গুলো নানা দেশে পড়ানো হচ্ছে সেগুলোও আসলে আমাদের এখানে আসা উচিত।
আমি আসলে দুই ধরনেরই মতামত দেখতে পাই। প্রসঙ্গটা হচ্ছে যে, কীভাবে আসলে এই বিষয়গুলো পাঠ্যবইয়ে নিয়ে আসা উচিত। কী উপায়ে এই নলেজটা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ট্রান্সফার করা হচ্ছে সেটা গুরুত্বপূর্ণ। এবং আপনি জানেন, শিক্ষা এরকম একটা বিষয় এখানে যেমন অনেক স্বতঃসিদ্ধ জ্ঞান আলোচনা করতে হয়, আবার অনেক সেনসিটিভ বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে হয়। এবং আমি একটু আগে যেটা বললাম যে, শিক্ষকরা আসলে প্রিপেয়ার্ড কিনা।
এরকম একটা সেনসিটিভ বিষয় নিয়ে শিক্ষকরা কীভাবে তাদের শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলবেন, সেই বিষয়ে শিক্ষকদেরকে আগে আসলে প্রস্তুত করার প্রয়োজন ছিলো। পাশাপাশি যেটাকে আমরা স্টেইকহোল্ডার বা অংশীদার বলে যেমন আমাদের প্যারেন্টস, অভিভাবক, শিক্ষক তাদের সাথে আসলে এনসিটিবির একটা দরকার ছিল বিভিন্ন পর্যায়ে তাদের কথা শোনা, তাদের অংশগ্রহণ কীভাবে নিশ্চিত করা যায় সেই মেকানিজমটা তৈরি করা।
আমি এই জায়গাটাতে একটা বড় গ্যাপ দেখতে পাই। ফলে যেটা হচ্ছে যে, অনেকের সংশয়, চিন্তা, দুশ্চিন্তা আসলে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।
তারেক নূরুল হাসান: সবকিছু কনসিডার করে আমাদের যে শিক্ষাক্রম দেওয়া হয়েছে সেটা অনুসারে পড়ানোর মতো প্রস্তুতি হয়তো আমাদের শিক্ষকদের এবং শিক্ষার্থীদেরও নেই। তারপরেও তো এটা চালু হয়ে গেছে। আমরা দেখতে পাবো যে, আমাদের ছেলেমেয়েরা এটার মধ্য দিয়েই যাবে। আপনি যদি বাস্তবতা নিরিখে ব্যাপারটা বিচার করেন এবং সংক্ষেপে আপনি যদি মনে করেন যে এই শিক্ষাক্রমটা চালু হওয়ার পরে কনসিডারিং অল দা ল্যাকিংস উই হ্যাভ এটা কি আমাদের জন্য ভবিষ্যতে ইতিবাচক কিছু বয়ে আনলে বলে আপনি মনে করেন?
গৌতম রায়: এটা নির্ভর করে সরকার আসলে এই শিক্ষাক্রমটা কীভাবে বাস্তবায়ন করছে সেটার ওপরে। আপাতত বর্তমান যে পরিস্থিতি সেটার ভিত্তিতে আমি যদি এভাবে বলি, আমি মনে করছি এই মুহূর্তে এটা আসলে ইতিবাচক প্রভাব হয়তো নিয়ে আসবে না।
তার একটা বড় কারণ হলো, আপনি দেখেছেন যে আমাদের এখানে পূর্বে ‘এসো নিজে করি’ আমরা যখন লেখাপড়া করেছি তখন এই বিষয়টা ছিলো। এটা কিন্তু একটা গুড কনসেপ্ট যে, আমি অনেক কিছুই নিজে নিজে করব। বই থেকে একটা ধারণা নিবো তারপর আমি নিজে নিজেই করবো।
কিংবা, কিছুদিন আগে আপনি দেখেছেন যে সৃজনশীল পদ্ধতি সেটাও কিন্তু একটা ভালো পদ্ধতি যে, শিক্ষার্থীরা মুখস্ত না করে তারা সৃজনশীল ওয়েতে তাদের নলেজ তারা প্রকাশ করবে। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, এসো নিজে করি বা সৃজনশীল দুটোই কিন্তু আসলে ব্যর্থ হয়েছে।
ব্যর্থতার একটি বড় কারণ হচ্ছে, আমার গ্রাউন্ড আমি প্রস্তুত না করেই নতুন কিছু একটা চাপিয়ে দিচ্ছি । সেই জায়গা থেকে আমি মনে করছি, এটা হয়তো ইতিবাচক প্রভাব নিয়ে আসতে পারবে না। বাট, বর্তমান যে শিক্ষামন্ত্রী, কিছুদিন আগে যিনি শিক্ষামন্ত্রী হলেন, তিনি একটা কথা বলেছেন যেটা আমার ভালো লেগেছে। সেটা হচ্ছে, তিনি বলেছেন এই যে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে সেটাকে কেন্দ্র করে আমরা শিক্ষাক্রমে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনবো।
আমি মনে করি, তিনি যদি এই সমালোচনা বা কনসার্নগুলো আমলে নেন, অর্থাৎ যে বিষয়গুলো নিয়ে শিক্ষাবিদদের আশঙ্কা, সেগুলো দূর করেন তাহলে হয়তো অনেক ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনা সম্ভব হতে পারে।
তারেক নূরুল হাসান: সেটাই। আমাদের শিক্ষাক্রমেও আসলে বাইরের বিশ্বের সাথে তুলনা করে পরিবর্তন আনা হচ্ছে। আপনার অভিজ্ঞতা কী বলে যদি অস্ট্রেলিয়ার শিক্ষাক্রমের সাথে আমরা বাংলাদেশের সমপর্যায়ে শিক্ষাক্রমে তুলনা করতে চাই, সংক্ষেপে তাহলে আপনার মূল্যায়নটা কেমন হবে?
গৌতম রায়: যেকোনো শিক্ষাক্রমে আমরা যে পরিবর্তনের কথা বলি, একটা নির্দিষ্ট সময় অন্তর এই পরিবর্তন করতে হয়। যুগের চাহিদার সাথে তাল মেলানোর জন্য, সময়ের সাথে তাল মেলানোর জন্য এবং অন্যান্য দেশের সাথে তাল মেলানোর জন্য এই পরিবর্তনটা আনতে হয়।
কিন্তু এটাও বলা হয় যে, কারিকুলামের যে পরিবর্তন সেটা হুট করে কোনো বড় পরিবর্তন না এনে আস্তে আস্তে সবাইকে প্রস্তুত করে পরিবর্তন আনা।
বাংলাদেশে আমরা যেটা দেখছি, যখনই এরকম শিক্ষাক্রম পরিবর্তনের কথা বলা হয়, একসাথে একটা বড় পরিবর্তন নিয়ে আসে, যেটা হয়তো আগেরটার চাইতে একটা বিশাল ভিন্ন ধরনের কিছু হয়। আমরা যদি অস্ট্রেলিয়ার সাথে তুলনা করি, তাহলে দেখবেন যে ওদের কারিকুলামের তারা আস্তে করে কীভাবে গ্র্যাজুয়াল বা ধারাবাহিক একটা পরিবর্তন আনছে। এই পরিবর্তনটা কিন্তু একটার সাথে আরেকটা ম্যাচ করতে হয়। কিন্তু আমাদের দেশে এটা নেই।
আপনার প্রথম প্রশ্নে আমি দুটো জিনিস বলেছিলাম যে, আমি আমার পিএইচডির কাজে দুটোর ডকুমেন্টস আমি রিভিউ করবো। একটা হচ্ছে, আর্লি ইয়ার্স লার্নিং ফ্রেমওয়ার্ক, আর একটা হচ্ছে অস্ট্রেলিয়ান কারিকুলাম সায়েন্স। আপনি খেয়াল করে দেখবেন যে, অস্ট্রেলিয়ান আর্লি ইয়ার্স লার্নিং ফ্রেমওয়ার্ক, এটা এখন চলছে ভার্সন ২ এবং আগে ছিল ভার্সন ১। এই যে অস্ট্রেলিয়ান আর্লি ইয়ার্স লার্নিং ফ্রেমওয়ার্ক এটাতে কিন্তু তারা আস্তে আস্তে কিছু পরিবর্তন আছে, মেজর কোনো পরিবর্তন তারা একসাথে আনেননি।
কিংবা অস্ট্রেলিয়ান কারিকুলাম সায়েন্স এটার ভার্সন এখন চলছে ৮.৪। তো, এই নাম্বারটা থেকে আপনি বুঝতে পারেন যে, ওরা আসলে টাইম টু টাইম বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তন আনছে।
কিন্তু, বাংলাদেশে আমরা যেটা দেখছি, যখনই এরকম শিক্ষাক্রম পরিবর্তনের কথা বলা হয়, একসাথে একটা বড় পরিবর্তন নিয়ে আসে, যেটা হয়তো আগেরটার চাইতে একটা বিশাল ভিন্ন ধরনের কিছু হয়। আমরা যদি অস্ট্রেলিয়ার সাথে তুলনা করি, তাহলে দেখবেন যে ওদের কারিকুলামের তারা আস্তে করে কীভাবে গ্র্যাজুয়াল বা ধারাবাহিক একটা পরিবর্তন আনছে। এই পরিবর্তনটা কিন্তু একটার সাথে আরেকটা ম্যাচ করতে হয়। কিন্তু আমাদের দেশে এটা নেই।
আমাদের যারা শিক্ষাক্রম রচনার সাথে যুক্ত ছিলেন, তারা বলছেন যে তারা অস্ট্রেলিয়া, ফিনল্যান্ড বা এরকম বিভিন্ন দেশকে সামনে রেখে কাস্টমাইজ করেছেন। কিন্তু আমি যেটা দেখতে পাচ্ছি যে, ওইসব দেশে যেভাবে পরিবর্তনটা করা হয় সেই পরিবর্তনটা কিন্তু বাংলাদেশে আসছে না। সো, আমরা যদি এই তুলনাটা এভাবে করতে চাই, আমি বলবো যে, বাংলাদেশে যেকোনো ধরনের পরিবর্তন, বিশেষ করে শিক্ষায় পরিবর্তনটা আনতে হবে আসতে ধীরে এবং আমাদের বাস্তবতার কথা মাথায় রেখে এবং আমাদের সক্ষমতার কথা মাথায় রেখে।
তারেক নূরুল হাসান: অনেক ধন্যবাদ আপনাকে আপনার মূল্যবান মতামত জানানোর জন্য। আর সেই সাথে এসবিএস বাংলাকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
গৌতম রায়: আমিও আমার পক্ষ থেকে এসবিএস বাংলাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি এই ইন্টারভিউয়ের জন্য। বিশেষ করে আমি এই ইন্টারভিউয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশের শিক্ষাক্রম নিয়ে আমার যে মন্তব্যগুলো, সেগুলো আমি করতে পারলাম সেজন্য আপনাদেরকে অনেক ধন্যবাদ।