ঢাকায় প্রথমবারের মতো উবারের সার্ভিস চালু হওয়ার পর মারাত্মক খুশি হয়েছিলাম দুটো কারণে। প্রথমত, সেই সময় সিএনজি অটোরিকশাওয়ালাদের দৌরাত্ম্য এতো বেশি বেড়েছিলো যে, তারা যাত্রীদের মানুষ হিসেবে গণ্য করতেন না। অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা তো করতে হতোই, ভাড়া ছিলো অসহনীয় পর্যায়ে। তারা এমন ভাড়া দাবি করতেন তা দরদামেরও অগম্য ছিলো। উবার এসে এই জায়গাটি থেকে মুক্তি দিয়েছে। দ্বিতীয়ত, আমার প্রচণ্ড রকমের ধুলা-অ্যালার্জি আছে। তাছাড়া গাড়ির হর্নের বিকট শব্দেও মাথাব্যথা শুরু হয়। দুটো সমস্যা থেকেই মুক্তি মিলেছে উবারের কারণে।
যেহেতু ব্যক্তিগত গাড়ি নেই, তাই উবার আসামাত্রই এর সার্ভিস লুফে নিয়েছি। আর্থিক বিবেচনায় যদিও এটি আমার জন্য ফিজিবল না কখনোই, কিন্তু কখনও কখনও দামের (price) চেয়েও মূল্যকে (value) প্রাধান্য দিতে হয়।
পটভূমি
অন্য বেশ কিছু বিষয়ের মতো উবারের যে-বিষয়টি শুরুতেই আকৃষ্ট করেছিলো, সেটি হচ্ছে সেবাদাতা ও সেবাগ্রহীতা উভয়েরই পরস্পরকে মূল্যায়ন করার প্রক্রিয়াটি, অর্থাৎ রেটিং ব্যবস্থা। যেকোনো কাজে পারস্পরিক মূল্যায়নের সফিসটিকেটেড পদ্ধতি থাকা প্রয়োজন। উবারে যাত্রী যেমন চালককে এক থেকে পাঁচ তারকার মধ্যে মূল্যায়ন করতে পারেন, একইভাবে চালকও যাত্রীকে মূল্যায়ন করতে পারেন। এতে হয়তো তেমন কিছু যায়-আসে না; কিন্তু অতি-সামান্য হলেও জবাবদিহিতার একটা পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এ-ধরনের কাজ অ্যাঙ্গার ম্যানেজমেন্টেও কাজে আসে।
প্রথম কিছুদিন পাঁচ তারকা রেটিং পাওয়ার পর একসময় খেয়াল করি, কোনো নির্দিষ্ট কারণ ছাড়াই আমার রেটিং উঠানামা করছে। বুঝা যাচ্ছে, কোনো কোনো উবার-চালক কম রেটিং দিচ্ছেন। অপরিচিত মানুষের ক্ষেত্রে আমি স্বাভাবিক সৌজন্য ও পেশাদারিত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করি। ফলে, এমন কোনো আচরণ বা কাজ করিনি যার কারণে আমার রেটিং কমে আসতে পারে।
অলস মস্তিষ্ক যেহেতু অপ্রয়োজনীয় বিষয়কে গুরুত্ব দেয়, তাই সিদ্ধান্ত নিলাম এমনটা কেন হচ্ছে তার কোনো গ্রহণযোগ্য উত্তর পাওয়া যায় কিনা তা বের করার চেষ্টা করা যায় কিনা দেখি।
এর মধ্যে দেশের বাইরে চলে যাই। সেই দেশে ও তার আশেপাশের দেশগুলোতেও কোনো কোনো সময় উবার ব্যবহার করতে হয়েছে এবং ওখানে কখনওই পাঁচ তারকার নিচে রেটিং পাইনি।
পরিকল্পনা
দেশে আসার পর পুনরায় বিষয়টি নিয়ে মনোযোগী হই। প্রথমেই নির্ধারণ করি আমি আসলে ঠিক কী জানতে চাই এবং কী পদ্ধতিতে কাজটি এগিয়ে নেয়া যায়।
যেহেতু আমার মূল আগ্রহের বিষয় হচ্ছে, চালকরা কেন কম রেটিং দেন, তাই আমি প্রথমেই আমার পূর্ব-অভিজ্ঞতা থেকে কম রেটিং দেওয়ার সম্ভাব্য কিছু কারণ বের করলাম। মনে হলো, প্রথম কারণটি হতে পারে— উবার-চালকের সঙ্গে প্রয়োজনের বাইরে কথা না বলা, ও দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, বখশিশ না দেওয়া।
উল্লেখ্য, ব্যক্তিগত পরিমণ্ডলে সাবলীল হলেও অপরিচিত মহলে কথা বা আড্ডায় আমি সড়গড় নই। তাছাড়া ভ্রমণে আমি আমার ব্যক্তিগত ভাবনা ও পরিকল্পনাগুলো গুছিয়ে নিই, কিংবা বাইরের দৃশ্য দেখতে পছন্দ করি। ফলে, উবার-চালকদের সঙ্গে প্রয়োজনের বাইরে তেমন একটা কথা বলা হয় না। অপরদিকে, বখশিশ দেওয়ার বিষয়টি প্রথমে আমার ভাবনাতেই আসেনি; কিন্তু যখন এই কাজের সিদ্ধান্ত এলো, তখন নেট ব্রাউজিং করে দেখেছি, বখশিশ দেওয়ার বিষয়টি বাধ্যতামূলক না হলেও এক্ষেত্রে উবারের নির্ধারিত কোনো নীতি নেই, এটি সম্পূর্ণই যাত্রী ও চালকের বিষয়। তাছাড়া, অনেকে বখশিশ দিয়ে যেমন অভ্যস্ত, তেমনি অনেক চালক বখশিশ পেয়েও অভ্যস্ত।
উপর্যুক্ত বিষয়ের পরিপ্রেক্ষিতে দুটো বিষয়ে অনুমাননির্ভর সিদ্ধান্ত (হাইপোথিসিস) গ্রহণ করি।
এক. চালকের সঙ্গে আড্ডার সুরে প্রচুর কথা বললে রেটিং বাড়ে।
দুই. বখশিশ দিলে রেটিং বাড়ে।
তথ্য সংগ্রহ
দুটো অনুমাননির্ভর সিদ্ধান্তকে যাচাইয়ের জন্য তিন পর্যায়ে পরীক্ষা করতে মনস্থ করলাম।
প্রথম পর্যায়. এ-পর্যায়ে কমপক্ষে ৫-৬টি রাইডে চালকদের সঙ্গে প্রচুর কথা বলবো, কিন্তু কোনো ধরনের বখশিশ দিবো না এবং তারপর রেটিং পরীক্ষা করবো।
দ্বিতীয় পর্যায়. এ-পর্যায়ে আমি একইভাবে ৫-৬টি রাইডে চালকদের সঙ্গে প্রয়োজনের বাইরে কথা বলবো না, কিন্তু কিছু বখশিশ দিবো এবং তারপর রেটিং পরীক্ষা করবো। বখশিশের পরিমাণ ঠিক করা হয়েছে এমন— যে পরিমাণ বিল দেখাবে, তার পরবর্তী সংখ্যা (সর্বোচ্চ ২০ টাকা) পর্যন্ত চালককে প্রদান করা। যেমন, ২৬২ টাকা বিল এলে ২৮০ টাকা দেয়া, ১৮৯ টাকা বিল এলে ২০০ টাকা দেয়া এভাবে।
তৃতীয় পর্যায়. এ-পর্যায়ে আমি স্বাভাবিকভাবে যেভাবে চড়ি, সেভাবেই চড়বো, এবং তারপর রেটিং পরীক্ষা করবো।
যেহেতু ঢাকার বাইরে থাকি, তাই প্রতিবার ঢাকায় আসার পর ৫-৬টি রাইডের সম্ভাবনা রয়েছে, এমন সময়ে পরীক্ষাগুলো করার সিদ্ধান্ত নিই।
তথ্য বিশ্লেষণের পরিকল্পনা
পুরো কাজটি ভালোভাবে সম্পন্ন করতে হলে তথ্যের বিশ্লেষণে সাযুজ্য ও সামঞ্জস্যের বিষয়টির প্রতি লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন। সেজন্য উদ্দেশ্যমূলকভাবে কিছু ধাপ অনুসরণ করা হয়েছে।
এক. উবার কখন কীভাবে যাত্রীদের রেটিং আপডেট করে তা জানা প্রয়োজন। প্রথমবার কয়েকটি রাইডের পর খেয়াল করেছি, উবার এক সপ্তাহ পর যাত্রীদের রেটিং আপডেট করে। যেমন, আমি যদি রবিবার উবার ব্যবহার করি, তাহলে সেটির রেটিং পরবর্তী রবিবার আপডেট করা হয়।
দুই. একাধিক রাইড পরীক্ষার পর দেখা গেছে, চালক যদি পাঁচ তারকা দেন, তাহলে দশমিকের দুই ঘর পর এক পয়েন্ট করে বাড়ে। একইভাবে, চার তারকা দিলে এক পয়েন্ট করে কমে। যেমন, যদি রেটিং থাকে ৪.৩৮, তাহলে পাঁচ তারকা দিলে তা বেড়ে হচ্ছে ৪.৩৯ এবং চার তারকা দিলে তা কমে হচ্ছে ৪.৩৭। তবে রাইডের পরিমাণ বাড়তে থাকলে এই অনুপাতে পরিবর্তন আসে। যেমন, রাইড বাড়লে একসময় দু’বার পাঁচ তারকা দিলে এক পয়েন্ট বাড়বে বা দু’বার চার তারকা দিলে এক পয়েন্ট কমবে। কেউ যদি আরও বেশি বেশি রাইড নেন, তাহলে তার ক্ষেত্রে তিন বা চার বারে পয়েন্ট বাড়বে বা কমবে এবং এভাবেই প্রক্রিয়াটি চলতে থাকে।
উল্লেখ্য, যেহেতু উবারের রেটিং কীভাবে পরিবর্তিত হয় সে বিষয়ে আমার জানা নেই, তাই আমার এই অনুমানির্ভর হিসাবে ভ্রান্তি থাকতে পারে। উক্ত হিসাব বা ধারণাটুকু পুরোপুরিই ব্যক্তিগত হিসাবনির্ভর।
তিন. কোনো চালক আমাকে চারের নিচে দেবেন না, এটি ধরে নেওয়া হয়েছে।
তথ্য সংগ্রহ ও ফলাফল
উপর্যুক্ত বিষয়গুলো চূড়ান্ত করার পর পরিকল্পনা অনুসারে তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু হয়।
এক. প্রথম পর্যায়ে চালকের সঙ্গে আড্ডার সুরে প্রচুর কথা বলি। ঢাকার যানজট নিয়ে, ধুলাবালি নিয়ে, উন্নয়ন কাজ নিয়ে, দেশের বাড়ি নিয়ে, পড়ালেখা বা বিদ্যালয় নিয়ে ইত্যাদি। প্রচুর কথা বললেও ওই রাইডগুলোতে আমি বখশিশ দিইনি। এমনকি, হাতে প্রচুর ভাঙতি টাকা রেখেছিলাম, শুধু ঠিক পরিমাণে বিল দেয়ার জন্য। যেমন, ১৮৩ টাকা বিল এলে ১৮৫ টাকা পরিশোধ করেছি বা ২০৮ টাকা হলে ২১০ টাকা। ফলাফল হচ্ছে, ওই সময়ে আমার নেওয়া সাতটি রাইডের দুটিতে রেটিং কমেছে, বাকিগুলোতে বেড়েছে।
দুই. দ্বিতীয় পর্যায়ে চালকদেরকে পূর্বে বর্ণিত সিদ্ধান্ত অনুসারে কিছু বখশিশ দিই; কিন্তু প্রয়োজনের বাইরে কোনো কথা বলিনি। ওই সময়েও আমার নেওয়া ছয়টি রাইডে কোনো রেটিং কমেনি।
তিন. তৃতীয় পর্যায়ে প্রচুর কথা বলেছি এবং বখশিশও দিয়েছি। ছয়টি রাইডে কোনো রেটিং কমেনি।
চার. চতুর্থ পর্যায়ে আমি আমার মতো করে থেকেছি। রেটিঙের উঠানামা শুরু হয়েছে। অনুমান—সাতটি রাইটের মধ্যে তিনটিতে কমেছে, বাকি চারটিতে বেড়েছে।
বিষয়টি সহজভাবে বুঝার জন্য নিচের গ্রাফটি দেখা যেতে পারে।
এ-থেকে ধারণা নেয়া যায়, বখশিশ প্রদান ও চালকদের সঙ্গে কথা বলার সাথে রেটিং বাড়ার একটি যোগবোধক সম্পর্ক রয়েছে।
ডিসক্লেইমার
এটি খুবই সীমিত পরিসরে ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ মাত্র, নমুনায়নের মাধ্যমে কোনো লব্ধপ্রতিষ্ঠিত নিয়ম অনুসরণ করে বা গবেষণার মানসে কাজটি করা হয়নি। সুতরাং, এ-থেকে কোনো ধরনের সিদ্ধান্তে পৌঁছা যাবে না বা এখানকার বক্তব্যকে সাধারণীকরণ করা যাবে না। একে ব্যক্তিগত পর্যায়ের কৌতুহলের একটি স্ন্যাপশট হিসেবেই বিবেচনা করতে হবে। পাশাপাশি, এই কাজটি নিছকই ব্যক্তিগত আগ্রহ থেকে করা হয়েছে। কোনো ধারণা প্রতিষ্ঠিত করা বা কোনো ইতিবাচক বা নেতিবাচক মত প্রদান করা এর উদ্দেশ্য নয়। শুধু নিজের আগ্রহ মেটানোর জন্যই কাজটি করা হয়েছে এবং এটি গবেষণা না হলেও দৈনন্দিন জীবনের সমস্যাগুলো কীভাবে গবেষণার ছকে ফেলে নিজের মতো করে সিদ্ধান্তে পৌঁছা যায়, সেটি এখানে বিধৃত হয়েছে।
রেটিঙের অন্যান্য বিষয়
সর্বশেষ পর্যায়ে রাইডের সময় চালকদের সঙ্গে রেটিং প্রসঙ্গ নিয়ে খোলাখুলিভাবে আলোচনা করি যে, তারা কীভাবে রেটিং দেন। তাদের সঙ্গে কথোপকথন থেকে যা বুঝা যায় নিম্নোক্ত বিষয়সমূহ (গুরুত্বের ক্রমানুসারে নয়) রেটিংকে প্রভাবান্বিত করে।
১. গলি থেকে যাত্রীকে পিক করা বা নামানো;
২. বখশিশ প্রদান;
৩. চালকের সঙ্গে কথা বলা;
৪. দুর্ব্যবহার;
৫. গন্তব্য পৌঁছানোর ক্ষেত্রে যাত্রীর নির্দেশনা;
৬. গাড়িতে যাত্রী দ্বারা বাজে গন্ধ;
৭. দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করিয়ে রাখা;
৮. এসি, গান, সিট ইত্যাদি নানা বিষয়ে ক্রমাগত অভিযোগ করা ইত্যাদি।
উপসংহার
আমার এই পর্যবেক্ষণ থেকে এটুকু অন্তত উঠে এসেছে যে, চালকের সঙ্গে কথা বলা ও বখশিশের সঙ্গে ভালো রেটিং পাওয়ার একটি যোগবোধক সম্পর্ক রয়েছে। যদিও এটি কোনো গবেষণা নয় বা এর দ্বারা কোনো ফলাফল দাবি করা অনুচিত, কিন্তু অন্য কারও ক্ষেত্রেও এমনটি বাস্তব হতে পারে।
উবার কর্তৃপক্ষ তার চালকদের নিয়মিত বিরতিতে প্রশিক্ষণ দেয় কিনা আমার জানা নেই, কিন্তু তাদের উচিত হবে এসব বিষয় নিয়ে চালকদের সঙ্গে খোলাখুলি আলোচনা করা। পরস্পরকে মূল্যায়ন করা ইতিবাচক কিন্তু এর যেন অপব্যবহার না হয়, সেদিকে নজর রাখা প্রয়োজন। একেক যাত্রী একেকরকম, কেউ কথা কম বলবেন, কেউ বা বেশি। দুর্ব্যবহার বা এরকম কোনো ঘটনা না ঘটলে এর প্রভাব মূল্যায়নে পড়া উচিত নয়। বখশিশের ক্ষেত্রেই একই কথা প্রযোজ্য।
পাশাপাশি, যাত্রীরাও কীভাবে উবার চালকদের রেটিং দিচ্ছেন, এমন বিষয়েও অনুসন্ধান বা জানাশোনার জায়গাটিও বাড়ানো যেতে পারে। পরস্পরের কাছে যতোই অপরিচিত হই না কেন আমরা, সবাই একই বা কাছাকাছি সোসাইটিতে বিলং করি। সামাজিক বিষয়ে আপাততুচ্ছ বিষয়ও ক্ষেত্রবিশেষে হয়ে উঠতে পারে আকর্ষণীয় অধ্যয়নের বিষয়।
খসড়া লেখাটি পড়ে মতামত দেয়ায় জাহাঙ্গীর মোহাম্মদ আরিফ, মুহাম্মদ মিজানুর রশীদ শুভ্র ও এনায়েতুর রহীমের প্রতি কৃতজ্ঞতা।