জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশন শুরু হতে মাস দুয়েকও বাকি নেই। ইতোমধ্যে বিভিন্ন জায়গায় বাজেট-পূর্ব আলোচনা শুরু হয়েছে। অর্থমন্ত্রী ও তাঁর মন্ত্রণালয় বাজেট বিষয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছেন এবং বিভিন্ন মহলের দাবিদাওয়া শুনছেন। আগামী বাজেটে সম্ভাব্য কী কী পরিবর্তন আসতে পারে, সেসব নিয়ে বিভিন্ন মিডিয়ায় খবরও প্রকাশিত হচ্ছে।
বাজেট বলতে আমরা সাধারণত আয়-ব্যয়ের হিসাব-নিকাশই বুঝে থাকি; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বাজেটের পরিধি আরও ব্যাপক। যে কোনো বিষয়ে বাজেট মূলত ওই বিষয়ের ওপর পরবর্তী এক বছরে সরকারের কর্মকাণ্ডের একটি গাইডলাইন হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। সুতরাং কোনো নির্দিষ্ট সেক্টরে কী পরিমাণ টাকা বরাদ্দ করা হল এবং কতটুকু খরচ হল, তার বাইরেও বাজেট ওই নির্দিষ্ট সেক্টরে আগামী এক বছরে কী পরিবর্তন আসবে বা আসা প্রয়োজন তার একটি দিকনির্দেশনা প্রদান করে। ফলে বাজেট তৈরির কর্মকাণ্ড বা সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়গুলো মন্ত্রণালয়ের একার ওপর নির্ভর করে না; এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে সরকারের অন্যান্য মন্ত্রণালয়ও। কোন মন্ত্রণালয়ের কী কী চাহিদা রয়েছে এবং এসব চাহিদার মধ্যে কোনগুলো অগ্রাধিকার পেতে পারে তার প্রতিফলন দেখা যায় জাতীয় বাজেটে। সেই সঙ্গে সরকারের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির প্রতিফলনও মেলে বাজেটে।
জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ জাতীয় সংসদে গৃহীত হওয়ার পর থেকে আমরা যারা শিক্ষা সেক্টরে কাজ করি, তারা প্রতি বছরই জাতীয় বাজেটের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করি। এই আগ্রহের মূল কারণ হচ্ছে, জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ বাস্তবায়নের জন্য যে ধরনের বাজেট দরকার, গতানুগতিক শিক্ষার বাজেট সেটি পূরণ করতে পারবে না। সুতরাং সরকার নতুনভাবে বাজেটে শিক্ষাবিষয়ে কী ধরনের দিকনির্দেশনা দেয়, সেটির প্রতি আগ্রহ থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু বাস্তবতা হল, ২০১০ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত কোনো বাজেটকেই শিক্ষানীতি-বান্ধব বাজেট বলে অভিহিত করা যাচ্ছে না। গতানুগতিকভাবে প্রতিটি সরকার যেভাবে শিক্ষাবাজেট প্রদান করে, তারই প্রতিফলন দেখছি বিগত কয়েক বছরে।
বর্তমান শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন করতে গেলে বেশ কিছু বিষয়ে খুব দ্রুত পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। এর একটি হচ্ছে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার সময়সীমা বাড়ানো। বর্তমানে আইন অনুসারে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার মেয়াদ পাঁচ বছর যা বর্তমান শিক্ষানীতি অনুসারে আট বছর অর্থাৎ অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বিস্তৃত হওয়ার কথা। প্রায় পাঁচ বছর চলে গেলেও এ বিষয়ে তেমন অগ্রগতি চোখে পড়ছে না। এর আগে একবার বলা হয়েছিল, সরকার ২০১৮ সালের মধ্যে ধারাবাহিকভাবে এটি বাস্তবায়ন করবে; কিন্তু বাস্তবতা দেখে আশান্বিত হতে পারছি না। তাছাড়া দেশে সাক্ষরতার হার বাড়ানোর কথাও শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছে এবং এটি সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকারের বিষয়। এ ব্যাপারেও অগ্রগতি আশানুরূপ নয়।
আমাদের দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি অনুসারে কোনো এক সরকার যা করে পরবর্তী সরকার এসে তার খোলনলচে পাল্টে দেয়। বর্তমান শিক্ষানীতি এ দিক দিয়ে সৌভাগ্যবান যে, যে সরকার শিক্ষানীতি নিয়ে কাজ শুরু করেছিল, তারাই পরবর্তী সময়ে এসে তার বাস্তবায়নের কাজ শুরু করেছে। কিন্তু যে উদ্যম ও পরিসরে কাজটি হওয়ার কথা ছিল, সেটির বেশ অভাব দেখা যাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই, শিক্ষানীতি অনুসারে দেশের শিক্ষার বড় কোনো অংশ পরিবর্তনের জন্য মূল যে ভূমিকা পালন করবে, তা হচ্ছে বাজেটে শিক্ষার জন্য বরাদ্দ। বাজেটে যদি যথাযথভাবে বরাদ্দ না দেওয়া হয়, তাহলে যত উদ্যোগই নেওয়া হোক না কেন, তা মুখ থুবড়ে পড়বেই। ২০১০ সালের পর থেকে প্রতিবারই শিক্ষাসেক্টরে কর্মরত ব্যক্তিরা শিক্ষানীতি-বান্ধব বাজেটের কথা বলে আসছেন, কিন্তু কোনোবারই তার প্রতিফলন দেখা যায়নি।
অস্বীকার করার উপায় নেই যে, জাতীয় বাজেটে যে খাতগুলোতে সর্বাধিক বরাদ্দ দেওয়া হয়, শিক্ষা তার মধ্যে একটি। শিক্ষায় সর্বাধিক বরাদ্দ দেওয়াটা আমাদের বাজেটের একটি ঐতিহ্য। সব অর্থমন্ত্রীই শিক্ষায় সর্বাধিক বরাদ্দের কথা বলে কৃতিত্ব নিতে চান; কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ের বাস্তবতা ভিন্ন। এখন শিক্ষাখাতের চেয়ে সামরিক খাত বরাদ্দ বেশি দেওয়া হচ্ছে। শিক্ষাখাতে যে বরাদ্দ থাকছে, তার সঙ্গে আরও কিছু খাত জুড়ে দেওয়া। ফলে প্রকৃতপক্ষে শিক্ষাখাত সর্বাধিক বরাদ্দ পাচ্ছে না। সবচেয়ে বড় কথা হল, সর্বাধিক বরাদ্দ পাওয়া বা না পাওয়া এখানে আলোচ্য বিষয় নয়। শিক্ষানীতির জন্য প্রয়োজনীয় বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে কিনা, তা-ই মূলত আলোচ্য বিষয় হওয়া প্রয়োজন। সে দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে গত কয়েক বছরের শিক্ষাবাজেট থেকে হতাশ হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না।
আগেই বলা হয়েছে, বাজেট কেবল আয়-ব্যয়ের খতিয়ান নয়, এটি একটি দিকনির্দেশনামূলক ডকুমেন্টও বটে। শিক্ষানীতি প্রণয়নের পর বাজেট বক্তৃতায় শিক্ষানীতি অভিমুখে নানা ধরনের উদ্যোগ গ্রহণের কথা বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে এর দৃশ্যমান দিকনির্দেশনা দেখা গেছে কম ক্ষেত্রেই। ইতোপূর্বে বাজেট-পরবর্তী আলোচনায় দুয়েক জায়গায় শিক্ষামন্ত্রী নিজেও এ ব্যাপারে হতাশা প্রকাশ করেছেন। এটা অস্বীকারের উপায় নেই যে, অর্থমন্ত্রী চাইলেই অন্যান্য সব সেক্টরে টাকা কমিয়ে শুধু শিক্ষাখাতে বরাদ্দ দিতে পারবেন না। তাঁকেও সব মন্ত্রণালয়, সব সেক্টর ব্যালেন্স করে চলতে হয়। কোনো একটি নির্দিষ্ট সেক্টরে বেশি বেশি বরাদ্দ দেওয়া তাঁর কাজের আওতায় পড়ে না, পড়া উচিতও নয়।
সে সঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে যে, শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের কাজ বছরের পর বছর ধরে হয় না। একটি নির্দিষ্ট সময় ধরে– তা হতে পারে চার থেকে পাঁচ বছর– স্বাভাবিক বাজেটে ফেরত যাওয়া যায়। তাছাড়া বর্তমান সরকার যেখানে মানব উন্নয়ন ও মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষা অন্যতম একটি হাতিয়ার হিসেবে মনে করছে, সেখানে ধারাবাহিকভাবে কয়েকটি বছর গতানুগতিকতার বাইরে গিয়ে শিক্ষাবাজেট প্রণীত হতে পারে। এ দিক বিবেচনা করলে গত কয়েকটি বাজেট আমাদের হতাশা উপহার দিয়েছে।
এ প্রেক্ষিতে আসছে বাজেটে শিক্ষাবাজেট নিয়ে ভিন্নতরভাবে ভাবতে অর্থমন্ত্রীকে আহ্বান জানাতে চাই। বর্তমান শিক্ষানীতিতে বেশ কয়েকটি বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে যার মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষার পরিসর বাড়ানো, প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রসার, নারীশিক্ষার প্রসার, বিজ্ঞান শিক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ ইত্যাদি। সম্পদের সীমাবদ্ধতার কারণে সবকিছু যে একসঙ্গে বাস্তবায়ন করা যাবে না, তা আমরা সবাই উপলব্ধি করি। কিন্তু প্রতি বছর একটি একটি করে বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে বাস্তবায়নের দিকনির্দেশনা প্রদান করা যায়। তাতে সরকারের ওপর শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের চাপ একসঙ্গে না পড়ে কাজ কিছুটা কমে যায়।
একই সঙ্গে আমরা আগামী বাজেটে বর্তমান শিক্ষানীতির কোন অংশ কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে, তারও অগ্রগতির একটি হিসাব দেখতে চাই। এ অগ্রগতি কেন্দ্র করে পরবর্তী তিন বছরের জন্য কী ধরনের কৌশল গ্রহণ করলে শিক্ষানীতির সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তসমূহ বাস্তবায়ন করা যাবে, সে সম্পর্কে দিকনির্দেশনাও চাই বাজেট বক্তৃতা থেকে। আগামী বাজেটে একই সঙ্গে শিক্ষার জন্য বরাদ্দ ও দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্যে আশাবাদী হওয়ার মতো উপাদান থাকা জরুরি।
* লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ-এর মতামত বিভাগে ২৫ এপ্রিল ২০১৫ তারিখে।