সংসদে অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতার পর শিক্ষা-বাজেটের প্রতি সরকারের গতানুগতিক মনোভাব দেখে হতাশ হয়েছিলাম, কিন্তু খুব বেশি অবাক হইনি। কারণ জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ সংসদে গৃহীত হওয়ার পরের দু-তিন বছরের শিক্ষা-বাজেট শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না। প্রথমে ভেবেছিলাম, ঠিক কোন পদ্ধতিতে বর্তমান শিক্ষানীতির বিপুল ব্যয়ভার বাস্তবায়ন করা হবে তা সম্ভবত সরকার ঠিক করতে পারছে না এবং সে কারণেই শিক্ষানীতি-বান্ধব শিক্ষা-বাজেট প্রদানে এই কালক্ষেপণ। কিন্তু এতদিন পর এখন– বেশ কয়েক বছর পর– মনে হচ্ছে, শিক্ষানীতির সুপারিশসমূহ দ্রুত বাস্তবায়নে সরকারের আগ্রহ কম।
অনেকের হয়তো এই উপলব্ধি আগেই হয়েছে; কিন্তু সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর আগে আমি কিছুটা সময় নিয়েছি। সময় নেওয়ার অন্যতম কারণ হল, কোনো কাজের বাইরে থেকে সে কাজের ব্যাপ্তি ও বিশালতা অনেক সময় আন্দাজ করা যায় না। শিক্ষানীতির নানা সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে হলে যে ধরনের কর্মযজ্ঞ দরকার, একটু বিস্তারিত পরিকল্পনা ও গুছিয়ে শুরু না করলে তা হযবরল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। সুতরাং সরকারকে এ-ধরনের বিশাল কাজ গুছিয়ে নেওয়ার জন্য দু-তিন বছর সময় দেওয়া যেতেই পারে।
মূল আশঙ্কার ক্ষেত্র ছিল একটি। তা হল, প্রাথমিক শিক্ষা পঞ্চম শ্রেণির পরিবর্তে অষ্টম শ্রেণি করার বিষয়টি বাস্তবায়ন করা। এ এক দুরূহ কাজ, যে কোনো অর্থেই। এজন্য প্রচুর অবকাঠামোগত উন্নয়ন করতে হবে এবং প্রচুর শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। দুটোই অর্থ ও সময়সাপেক্ষ। ফলে অন্তত এই দুটো বিষয়ের কারণে হলেও সরকার সময় নিলে সেটি অযৌক্তিক হত না।
আর মেয়াদের শেষ বছরে এসে কোনো সরকার শিক্ষা-বাজেট দিবে, আমাদের এই দেশে এটা আশা করা নির্বুদ্ধিতা। বিষয়গুলো মেনে নেওয়া কষ্টকর হলেও এগুলো আসলে বাস্তবতা। ২০১৪ সালে যখন আওয়ামী লীগই পুনরায় সরকার গঠন করল, তখন মোটামুটি নিশ্চিত ছিলাম– এবার থেকে নিশ্চয়ই সরকার শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে উঠেপড়ে লাগবে।
সে হিসেবে এবার যখন দেখলাম শিক্ষা-বাজেট সেই গতানুগতিক– তখন ভালোভাবেই উপলব্ধি করলাম যে, এ বিষয়ে সরকারের আগ্রহ আসলেই কম। ৯ জুন সংসদে একজন সংসদ সদস্যের প্রশ্নের জবাবে শিক্ষামন্ত্রী সেটি আরও স্পষ্ট করলেন। উক্ত সংসদ সদস্য এবারের বাজেটে এমপিওভুক্তি বন্ধ হয়ে গেল কেন তা জানতে চেয়েছিলেন। তিনি এই প্রক্রিয়াটি একেবারে বন্ধ না করে কিছুটা চালু রাখতেও পরামর্শ দিয়েছিলেন।
এ প্রশ্নের দীর্ঘ উত্তরে শিক্ষামন্ত্রী বর্তমান সরকারের শিক্ষার প্রতি আগ্রহের কথা জানিয়ে এর বাইরেও যে সরকারের আরও কিছু জরুরি অগ্রাধিকার খাত রয়েছে তা বারবার বলার চেষ্টা করলেন। যদিও শিক্ষামন্ত্রী শিক্ষার জন্য আরও বরাদ্দ প্রয়োজন বলে মনে করেন, কিন্তু সেসব জরুরি খাতের কারণে তা পারা যাচ্ছে না বলে জানালেন সংসদে।
শিক্ষামন্ত্রীর অকপট কথা ভালো লাগে। শিক্ষা-বিষয়ক বেশ কিছু সভা-সেমিনারে তাঁর বক্তব্য শোনার সৌভাগ্য হয়েছে। তাঁর শব্দচয়ন, বক্তব্যের গভীরতা ও শিক্ষার প্রতি হৃদয়গ্রাহী আগ্রহ এবং বেশ কিছু ইতিবাচক কর্মকাণ্ড (উদাহরণস্বরূপ, প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের সব শিক্ষার্থীকে বিনামূল্য বই বিতরণ) ইতোমধ্যে শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে তাঁকে অন্যরকম উচ্চতায় নিয়ে গেছে।
তাঁর ব্যর্থতাও নিয়েও অনেক কথা আছে। মন্ত্রী হিসেবে তাঁর সফলতা ও ব্যর্থতার খতিয়ান ভিন্ন আলোচনার বিষয়। কিন্তু সংসদে তিনি সেদিন যেভাবে শিক্ষা-বাজেট বরাদ্দের বিষয়ে ব্যাখ্যা দিলেন, তাতে মনে হয়েছে তিনি নিজেই শিক্ষায় বেশি বরাদ্দ না দেওয়ার ব্যাপারে কনভিন্সড।
কোনো সন্দেহ নেই, বাংলাদেশে করার মতো প্রচুর কাজ রয়েছে। চাইলে জরুরি অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত এমন দশ-বারোটি খাত বানানো যাবে; কিন্তু শিক্ষা তো সবসময়ের জন্যই এমন এক জরুরি খাত, যার চারা আজ রোপন করা হলে ফল পাওয়া যায় বিশটি বছর পর। এই দূরদর্শিতা আমরা কবে দেখাব? বাজেট এক বছরের, কিন্তু বাজেটের রেশ থাকে বহু বছর। আমাদের বাজেটে আমরা কি সেই দূরদর্শিতা দেখতে পাই? পেলে কতটুকু দেখতে পাই?
অবস্থা এমন হয়েছে যে, শিক্ষাখাতে এখন আর জরুরি অগ্রাধিকারভিত্তিক বাজেট চাই না; চাই ‘স্বাভাবিক’ বাজেট। যে স্বাভাবিক বাজেটের কথা বিভিন্ন সময়ে সুপারিশ করা হয়েছে শিক্ষা-বিষয়ক নানা ফোরাম থেকে, নানা ক্ষেত্র থেকে, সেই স্বাভাবিক বাজেট আশা করতে চাই। অর্থাৎ জিডিপির ৬% বা জাতীয় বাজেটের অন্তত ২০ ভাগ শিক্ষা-বাজেটের দিকে বাংলাদেশের শুভযাত্রা দেখতে চাই আগামী বছর থেকে।
তবে এ আশাবাদের ভিত্তিটুকু আসলে দুর্বল। গত কয়েক বছরের বাজেটের দিকে যদি তাকাই, তাহলে সব মিলিয়ে এক হতাশাব্যঞ্জক পরিস্থিতিই দেখতে পাই। প্রতি বছর বাজেটে শিক্ষাখাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দের কথা বলা ফ্যাশন, কারণ শিক্ষা-বাজেটে সর্বাধিক বরাদ্দ দিলে মানুষ প্রশংসা করে। কিন্তু সত্যিকার অর্থেই কি শিক্ষাক্ষেত্রে বেশি বরাদ্দ দেওয়া হয়?
উত্তর হচ্ছে, না। শিক্ষার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয় নানা অনুষঙ্গ, অনেক টাকা চলে যায় সেসব খাতে। আর যতটুকু প্রয়োজন, ততটুকু না দিয়ে সর্বোচ্চ বরাদ্দের বাহানা অনেক ক্ষেত্রেই হাস্যকর হয়ে দাঁড়ায়। গ্রাফ ১ থেকে দেখা যাচ্ছে, ২০১১-১২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত বাজেটে শিক্ষার জন্য বরাদ্দের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছেই। কিন্তু এটুকুতে থেমে না থেকে পরবর্তী বিশ্লেষণে গেলেই শুভঙ্করের ফাঁকিটা পরিষ্কার হয়ে যায়।
জাতীয় বাজেটের কত শতাংশ শিক্ষার জন্য বরাদ্দ করা হয়, সেই হিসাব করলে দেখা যায়, দিন দিন শিক্ষার জন্য বরাদ্দের হার কমছেই। মজার বিষয় হল, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর শিক্ষার জন্য সর্বোচ্চ অর্থাৎ জাতীয় বাজেটের ১৫.৬% বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল ২০০৭-০৮ অর্থবছরে, অর্থাৎ বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। যে কাজ গণতান্ত্রিক সরকারের করার কথা, তার কিছুটা প্রতিফলন দেখা গেছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। এমনকি শিক্ষানীতি প্রণয়নের পরের বছর শিক্ষাখাতে মোট বাজেটের ১৪.২% বরাদ্দ ছিল। এখন তাহলে কমছে কেন?
নিজেরা কতটুকু ভালো আছি, তা অনেক সময় দেখতে হয় অপরকে সামনে রেখে। গ্রাফ ৩ থেকে দেখা যায়, দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভুটান কিংবা মালদ্বীপ বাংলাদেশের চেয়ে বহুগুণে তাদের সম্পদ শিক্ষার জন্য বরাদ্দ করছে। কিউবার কথা বাদ দিলাম, বাদ দিলাম অন্যান্য অনেক উন্নত দেশের কথা; এই দক্ষিণ এশিয়াতে একমাত্র পাকিস্তানের শিক্ষা-বাজেটই (জিডিপির ২.১%) বাংলাদেশের চেয়ে কম। ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা এ খাতে আজ থেকে বছর বছর আগে যে বিনিয়োগ করেছে, তার সুফল তারা পেতে শুরু করেছে এখন। দিন দিন তারা বরাদ্দ আরও বাড়াচ্ছে।
আমরা যদি এ-বছর থেকেও শিক্ষা-বাজেট জিডিপির ৬ শতাংশ হারে বরাদ্দ করতে শুরু করি, তাহলে এর সুফল পেতে অন্তত ১০-১৫ বছর লেগে যাবে। কিন্তু আমরা যে এখনও শুরুই করিনি!
সংসদে বাজেট পেশ হয়েছে মাত্র, বিস্তার আলোচনা-সমালোচনা হবে। দাবি-দাওয়া ইতোমধ্যে উঠেছে অনেক, আরও উঠবে হয়তো। এগুলোর মধ্য থেকে অর্থমন্ত্রী কিছু বিবেচনা করবেন, কিছু আগের মতোই রাখবেন এবং সবশেষে বাজেট পাশ হবে সংসদে। এ অবস্থায় অর্থমন্ত্রীর কাছে ভিন্ন কিছু চাইছি না– দুটো বিষয় ছাড়া–
এক.
এবারে না পারলেও আগামী বাজেট থেকে যেন শিক্ষাখাতে প্রতি বছর দশমিক পাঁচ শতাংশ হারে বাড়ানো হয় এমন একটি নির্দেশনা থাকুক বর্তমান বাজেটে। অর্থাৎ এ বছর শিক্ষাখাতে ২.৩ শতাংশ বরাদ্দ করা হলে তা আগামী বছর তা হবে ২.৮ শতাংশ, পরের বছর হবে ৩.৩ শতাংশ– এভাবে প্রতি বছর পরিমাণ বাড়বে।
দুই.
বাজেট শুধু অর্থকড়ির বিষয় নয়; তা দেশকে আগামী বছরগুলোতে কোন দিকে যাবে তারও দিকনির্দেশনা দেয়। আগামী বছর থেকে শিক্ষা-বাজেট যেন অন্তত শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের উপযোগী হয়, সে রকম পরিকল্পনার নির্দেশনা ও বাস্তবায়নের রূপরেখা চাই বাজেটে।
শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে যে প্রশ্ন উঠেছে ইতোমধ্যে, তা দূর করার কাজটুকু সরকারকেই করতে হবে।
পাদটীকা: বিভিন্ন সূত্র থেকে বাংলাদেশ ও অন্যান্য দেশের বাজেট-সংক্রান্ত তথ্য একত্র করে প্রবন্ধে ব্যবহৃত গ্রাফগুলো লেখক কর্তৃক তৈরি করা হয়েছে।
* লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ-এর মতামত বিভাগে ১০ জুন ২০১৪ তারিখে।