ক.
জনপ্রিয় লেখক ও শিক্ষানুরাগী ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল সাম্প্রতিক ‘মৃত ঘোড়া সমাচার’ শিরোনামে যে প্রবন্ধটি লিখেছেন [১], সেটির সঙ্গে একাত্মবোধে শামিল হয়ে বাড়তি কিছু মত দেওয়া এবং দু-একটি ক্ষেত্রে দ্বিমত পোষণ করে বিকল্প প্রস্তাবনা দেওয়া এই লেখাটির উদ্দেশ্য। জাফর ইকবাল স্যারের লেখাটি দেশের প্রায় সব প্রধান সংবাদপত্র এবং অনলাইন নিউজ মিডিয়াতে প্রকাশিত হয়েছে। একসঙ্গে এত জায়গায় বক্তব্য পৌঁছানোর মতো পরিচিতি এ লেখকের নেই। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে যেহেতু নিয়মিত লিখি, তাই এই প্ল্যাটফর্মটির মাধ্যমেই আমার বক্তব্যটুকু প্রকাশ করতে চাই। আশা করছি, জাফর ইকবাল স্যারসহ যারা এসব বিষয় নিয়ে ভাবছেন, লেখাটি তাঁদের চোখে পড়বে।
খ.
ইংরেজিতে measurement, assessment and evaluation নামে তিনটি আলাদা শব্দ আছে। তিনটির বৈশিষ্ট্য তিন ধরনের। ইন্টারনেটে খুঁজলে এসব বৈশিষ্ট্য সহজেই পাওয়া যাবে। এছাড়া evaluation-এর মধ্যে formative ও summative evaluation এবং পরীক্ষার মধ্যে test ও examination-এর পার্থক্যগুলোও সুস্পষ্ট। এতগুলো শব্দের অস্তিত্ব এটাই প্রমাণ করে যে, শিক্ষার্থী কী শিখছে বা কী জানতে পারছে— তা পরিমাপ ও মূল্যায়ন করা একেবারে সহজ কাজ নয়। এসব পার্থক্যের কথা মাথায় রেখে শিক্ষার্থীকে কখন ও কীভাবে মূল্যায়ন করা হবে তা ঠিক করা একটি বিজ্ঞানসম্মত প্রক্রিয়া।
শিক্ষার্থী কী শিখছে বা কী জানতে পারছে, তা পরিমাপ ও মূল্যায়ন করা সহজ কাজ নয়
প্রচলিত শিক্ষণ-ভিত্তিক (teaching-based) প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীর অর্জিত জ্ঞানের পরিমাপ করা হয় একেবারে শেষে— যেভাবে আমাদের বার্ষিক বা সমাপনী পরীক্ষাগুলো অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এ প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীর সারা বছরের অর্জনের তেমন কোনো মূল্য থাকে না। পাশাপাশি পড়ালেখার বাইরে শিক্ষার্থীর যে আরও বেশ কিছু দক্ষতা ও গুণাবলী বিদ্যালয়-ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার কথা, সেগুলো যথাযথভাবে মূল্যায়িত হয় না। এ প্রক্রিয়ায় শিক্ষক যতটুকু সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন, শিক্ষার্থীকে ততটুকু নিষ্ক্রিয় হতে দেখা যায়।
অপরদিকে শিখন-ভিত্তিক (learning-based) প্রক্রিয়ায় পড়ালেখার মূল ফোকাসটুকুই থাকে শিক্ষার্থীর কর্মকাণ্ডের ওপর। সেখানে শিক্ষার্থী নানা কর্মকাণ্ডে সক্রিয় থাকবে এবং শিক্ষক সেভাবে সহায়ক ভূমিকা পালন করবেন বলে মনে করা হয়। শিখন-ভিত্তিক প্রক্রিয়ার একটি অত্যাবশ্যক উপাদান হল, শিক্ষার্থীর অব্যাহত শিখনে সময়ে সময়ে তাকে মূল্যায়ন করে সে অনুযায়ী ফিডব্যাক প্রদান করা। বছর কিংবা নির্দিষ্ট সময় শেষে শিক্ষার্থী সার্বিকভাবে কী শিখল তাও সেখানে পরিমাপ করা হয়, কিন্তু সারা বছরের অব্যাহত মূল্যায়ন সেখানে সমানভাবে কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
গ.
সাম্প্রতিক সময়ে পিএসসি এবং জেএসসি পরীক্ষার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠছে সঙ্গত কারণেই। আমাদের বর্তমান শিক্ষানীতি প্রণয়নে যিনি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন, সেই জাফর ইকবাল স্যারেরই আরেকটি লেখা থেকে আমরা জানতে পারি যে, তাঁদের প্রস্তাবে পিএসসি বা এ-ধরনের পরীক্ষার প্রস্তাবনা ছিল না; কিন্তু পরে তা যুক্ত করা হয়। পিএসসি পরীক্ষা শিক্ষার্থীদের ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলছে, সে সম্পর্কে ইতোমধ্যে সবাই অবগত, সুতরাং সেটি আর এখান আলোচনা করছি না।
এই পরীক্ষা পদ্ধতিটি শুরুর আগে কিন্তু বেশ কিছু জায়গায় পাইলটিং করা হয়েছিল। সরকার যখন প্রথমবারের মতো সারা দেশে পিএসসি পরীক্ষার উদ্যেগ নেয়, তখন এটিকে স্বাগত জানিয়েই সচলায়তন ব্লগে লিখেছিলাম [২]। স্বাগত জানানোর কারণগুলো উক্ত লেখায় দেওয়া আছে, কিন্তু এখানে কিছুটা বলা যেতে পারে।
একটি বড় কারণ ছিল বৃত্তি পরীক্ষা। সে সময় বিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থীদের নিয়ে আলাদা বৃত্তি পরীক্ষার আয়োজন করা হত। ফলে শিক্ষকরা অধিক বৃত্তি পাওয়ার আশায় তাঁদের সমস্ত প্রচেষ্টা শুধু বিদ্যালয়ের গুটিকতক মেধাবী শিক্ষার্থীর দিকেই ঢেলে দিতেন। অপেক্ষাকৃত দুর্বল শিক্ষার্থীরা হত উপেক্ষিত। তাদের অনেকেই ঝরে পড়ত এবং যারা কোনোমতে টিকে থাকত, তাদের অবস্থা হত আরও করুণ। তাছাড়া একটি বড় অংশের শিক্ষার্থীকে বার্ষিক পরীক্ষা ও বৃত্তি পরীক্ষা উভয়টিতেই অংশ নিতে হত।
এর বাইরেও বেশ কিছু কারণ ছিল। সব মিলিয়ে সরকার এ সমস্যার বিকল্প বের করার জন্য একাধিক উপজেলায় প্রাথমিকভাবে পাইলট প্রজেক্ট চালানোর পরই চূড়ান্তভাবে সারা দেশে সমাপনী পরীক্ষা চালু করে। আশা ছিল, সমাপনী পরীক্ষায় যেহেতু সবাইকে অংশগ্রহণ করতে হবে, তাই শিক্ষকদেরকে সব শিক্ষার্থীকে সমানভাবে নজর দিতে হবে। সবাইকে সমানভাবে গড়ে তুলতে হবে।
যে ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে পরীক্ষাটি চালু হয়েছিল, তার দুর্বলতা এখন বেশ প্রকটভাবে ফুটে উঠেছে। এ কারণে সমালোচনার ধারগুলোও দিনদিন প্রকট হচ্ছে। সবচেয়ে বড় সমালোচনা হচ্ছে, আমরা দিন দিন পরীক্ষা-পদ্ধতিনির্ভর ব্যবস্থার দিকে ঝুঁকছি। এতে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য শিক্ষার্থীর বিকাশের পরিবর্তে সার্টিফিকেট অর্জনের দিকে ঝুঁকছে। একদিকে বিপুল পরিমাণ শিক্ষার্থী জিপিএ ৫ অর্জন করছে, অন্যদিকে শিক্ষাবিদরা শিক্ষার গুণগত মান অর্জন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন। দুটো বিপরীতধর্মী। পুরো ব্যবস্থাটিতে শিক্ষার্থীদের কোনো হাত নেই, বরং আমরা তাদেরকে তাদের পড়ালেখার কাজে কতোটুকু সহায়তা করতে পারছি— সেই প্রশ্নটিই দিন দিন মূখ্য হয়ে উঠছে।
গ.
অনেকের হয়তো জানা নেই, বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষার্থীরা প্রতিটি শ্রেণিতে কী কী শিখবে তা সুস্পষ্টভাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে [৩]। এতটা সুস্পষ্ট নির্দেশনা কিংবা গাইডলাইন মাধ্যমিক বা উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে নেই। শিক্ষার্থী প্রথম শ্রেণিতে যা শিখবে, তার উচ্চতর শিখন ঘটবে দ্বিতীয় শ্রেণিতে। কিছু কিছু বিষয় শিক্ষার্থী একাধারে একাধিক শ্রেণিতে ভাগ ভাগ করে শিখবে। শিক্ষাবিজ্ঞানের পরিভাষায় এগুলোকে বলা হয় শ্রেণিভিত্তিক ও বিষয়ভিত্তিক অর্জন উপযোগী যোগ্যতা। এগুলো কেন্দ্র করে শিক্ষার্থী প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার পর সার্বিকভাবে কী শিখল তা যাচাই করার জন্য রয়েছে একগুচ্ছ প্রান্তিক যোগ্যতা।
প্রশ্ন—
১) শিক্ষার্থী বিভিন্ন শ্রেণিতে বার্ষিক পরীক্ষায় যে ধরনের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে, তাতে কি ওই শ্রেণির যোগ্যতাগুলো যাচাই করা হয়?
২) ওই যোগ্যতাগুলো কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীকে সারা বছরে নানা কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে যাচাইয়ের কোনো ব্যবস্থা আমাদের বিদ্যালয়গুলোতে আছে কি?
৩) সমাপনী পরীক্ষাটি যে আদলে নেওয়া হয় তা কি প্রান্তিক যোগ্যতানির্ভর?
তিনটিরই উত্তর হচ্ছে— না। যদি তা-ই হয়, তাহলে শ্রেণিভিত্তিক, বিষয়ভিত্তিক ও প্রান্তিক যোগ্যতানির্ভর প্রাথমিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা কী? ইদানিং বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা (এনসিটিবিসহ) প্রান্তিক যোগ্যতানির্ভর মূল্যায়নের কাজ শুরু করেছে, কিন্তু তা এখনও মূলস্রোতের কিছু নয়। আমাদের প্রাথমিক শিক্ষার শিক্ষাক্রম (curriculum) ও পাঠ্যবই এসব প্রান্তিক যোগ্যতানির্ভর, কিন্তু পরীক্ষা বা মূল্যায়ন-পদ্ধতি নয়। পরীক্ষায় যেসব প্রশ্ন আসে, সেগুলো মূলত বিষয়বস্তুভিত্তিক যেখানে শিক্ষার্থীর মুখস্তবিদ্যা পরীক্ষায় অন্যতম ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে। প্রশ্নপত্র ফাঁস হলে তাই একদিকে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়, অন্যদিকে তেমনি আতঙ্ক কাজ করে।
আমরা চাচ্ছি, আমাদের শিক্ষার্থীরা যেন নির্ধারিত প্রান্তিক যোগ্যতাসমূহ পাঁচ বছরের প্রাথমিক শিক্ষাশেষে অর্জন করে। কিন্তু এর জন্য বিদ্যালয়ে যে ধরনের আয়োজন থাকার কথা, তা নেই। প্রান্তিক যোগ্যতার সবকিছুই প্রশ্নের উর্ধ্বে নয়। অনেক প্রান্তিক যোগ্যতা রয়েছে যেগুলো সত্যিকার অর্থে প্রান্তিক যোগ্যতা হতে পারে কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। তাছাড়া পাঠ্যবই ও শিক্ষক নির্দেশিকাসমূহ প্রান্তিক যোগ্যতা কেন্দ্র করে রচিত হওয়ার কথা থাকলেও সেগুলো পূর্ণাঙ্গভাবে প্রান্তিক যোগ্যতাগুলো প্রতিফলিত করে কিনা, তাও গবেষণার বিষয়।
প্রসঙ্গত বলা যায়, ২০০৮ সালে সে সময়ের প্রাথমিক স্তরের বাংলা ও গণিত বইগুলো কতটুকু প্রান্তিক যোগ্যতা প্রতিফলিত করে তা নিয়ে দুটো গবেষণা হয়েছিল [৪] [৫]। দেখা গেছে, কোনো বইতেই সবগুলো প্রান্তিক যোগ্যতা প্রতিফলিত হয়নি। এখন প্রান্তিক যোগ্যতা যেমন বদলে গেছে, তেমনি বদলে গেছে পাঠ্যবইও। এ ধরনের গবেষণা আরও করা প্রয়োজন। প্রান্তিক যোগ্যতাভিত্তিক প্রাথমিক শিক্ষা যখন থেকে চালু করা হয়েছিল, তখন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নিশ্চয়ই ভেবেচিন্তে একে ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন; কিন্তু এতোদিনেও মূল্যায়ন পদ্ধতি সে অনুসারে চালু করা যায়নি। এ অবশ্যই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার একটি বড় ব্যর্থতা, যার কারণে শিক্ষার্থীকে মূল্যায়িত হতে হচ্ছে ভুলভাবে।
ঘ.
পাশাপাশি এখন সৃজনশীলতারও বন্যা চলছে। কিন্তু সৃজনশীল প্রশ্ন প্রণয়নের নামে যেভাবে নানা বিষয়ের প্রশ্ন করা হচ্ছে, তার সঙ্গে শিক্ষাবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা বিষয়টিকে যেভাবে দেখেন, তার বিস্তর ফারাক রয়েছে। কর্তৃপক্ষ বর্তমান ফরম্যাট নির্ধারণ করার আগে শিক্ষাবিজ্ঞান-সংশ্লিষ্ট কতজনের মতামত নিয়েছে বা তাদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন তা আমার জানা নেই। সৃজনশীলতার নামে ভুলভাবে শিক্ষার্থীদের যাচাই করার ফলেও শিক্ষার্থীরা মুখস্তবিদ্যার বলয় থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না।
এ প্রসঙ্গে বিনয়ের সঙ্গে জাফর ইকবাল স্যারের একটি উদ্যোগের প্রতি ভিন্নমত পোষণ করতে চাই। ‘মৃত ঘোড়া সমাচার’ লেখাটিতে তিনি সৃজনশীল প্রশ্নপত্র crowd sourcing করার কথা বলেছেন। বিষয়টি শুনতে আপাতদৃষ্টিতে চমকপ্রদ মনে হলেও একটা সময়ে এটি নব্বইয়ের দশকের ‘প্রশ্নব্যাংক’-এর মতো হয়ে যেতে পারে। এটি দীর্ঘমেয়াদে আদৌ কোনো ফল বয়ে আনবে কিনা এ ব্যাপারে আমি সন্দিহান। মূল সমস্যা প্রশ্ন তৈরির প্রক্রিয়ার মধ্যে যতটুকু রয়েছে; তার চেয়ে বেশি রয়েছে শিক্ষার্থীরা কীভাবে উত্তর লিখবে তার মধ্যে এবং কীভাবে তা মূল্যায়ন করা হবে তার মধ্যে।
আমাদের আসলে তাকানো উচিত মূল্যায়ন ব্যবস্থার সবগুলো উপাদানের প্রতি। শিক্ষার্থীদের যদি প্রথম থেকেই সৃজনশীল পদ্ধতিতে মূল্যায়ন করা হয়, তাহলে একটা পর্যায়ে মুখস্তবিদ্যার অপ্রতিহত প্রভাব যেমন কমে যাবে; তেমনি সৃজনশীল প্রশ্ন নিয়ে এত মাথা ঘামানোরও প্রয়োজন পড়বে না। একেক শিশু বেড়ে উঠে একেকভাবে, একেক ধরনের অভিজ্ঞতা, কল্পনা, রোমাঞ্চ ও মানমানসিকতা নিয়ে। একই বিষয় একেকটি শিশুর কাছে একেকভাবে ধরা দেয়। আমরা যদি সেগুলোই তুলে আনার চেষ্টা করি তাদের মধ্য থেকে, তাহলেই কেবল সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটবে। অন্যথায় নয়।
ছোটবেলা থেকে আমরা নোট বা গাইড বই থেকে গরুর রচনা মুখস্ত করতে করতে বেড়ে উঠি। কিন্তু প্রত্যেক শিশু আলাদা আলাদাভাবে তাদের পরিচিত প্রাণিটিকে কীভাবে বর্ণনা করতে চায়, কীভাবে সে গরুটিকে দেখে— তার সেই অনুভূতিগুলো কি আমাদের মূল্যায়ন পদ্ধতি বের করতে আনতে সমর্থ? চারটি পা, দুটি চোখ আর একটি লেজ-সমৃদ্ধ গরু আমাদের সব শিশুর কলমের আগায় আর মস্তিষ্কের ভেতরে। এই বর্ণনার বাইরে গিয়ে গরু দেখার ভিন্ন কোনো প্রক্রিয়ায় আমাদের শিশুদের বড় করে তুলি না। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় এটাই বাস্তবতা।
এটি কেবল একটি উদাহরণ। শিশুদের কল্পনাশক্তি এবং সৃজনশীলতা আমরা এভাবে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে ফেলি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে। শিক্ষকদের চিন্তা-চেতনা এবং বইয়ের প্রচলিত ফরম্যাটের বাইরে গেলেই শিশুর সৃজনশীলতা শূন্য নম্বর পায়। বলতেই হয়, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এবং শিক্ষকবৃন্দ অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিশুদের সৃজনশীলতা ধারণ করতে সক্ষম নয়।
সদ্যপ্রয়াত শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী বলেছিলেন:
ছোটরা খুব রোমাঞ্চপ্রিয়। আমরা যে গাছের পাতাটা সবুজ আঁকি, ওরা সেটা লাল আঁকতে দ্বিধা করে না। ওদের কল্পনাশক্তি আমাকে সব সময় মুগ্ধ করে [৬]।
শিশুদের সৃজনশীলতা সম্পর্কেও শিল্পীর এই উক্তি আমি যথার্থ বলে মনে করি। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সৃজনশীলতা রচিত হোক শিক্ষার্থীর সৃজনশীলতা কেন্দ্র করে, শিক্ষকের কিংবা প্রশ্নের সৃজনশীলতা কেন্দ্র করে নয়। কাজটি কঠিন এবং সময়সাপেক্ষ সন্দেহ নেই, কিন্তু শুরু তো করতে হবে। না হয় কোনো এক পাইলট প্রকল্পের আওতাই তা শুরু হোক এবং তারপর তা ছড়িয়ে যাক সারা দেশে। দেশে এখন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষাবিজ্ঞানের শিক্ষক ও গ্র্যাজুয়েট আছেন। তাঁদেরকে এ ধরনের উদ্যোগে সহজেই সম্পৃক্ত করা যেতে পারে।
ঙ.
জাফর ইকবাল স্যার চমৎকারভাবে ঘোড়া নাচানাচির উদাহরণ দিয়েছেন। তাঁর প্রফেসর তাঁকে বলেছিলেন:
…যতক্ষণ লাফ-ঝাঁপ দিচ্ছে, সেটা নিয়ে নাচানাচি কর, সমস্যা নেই। কিন্তু যদি দেখ ঘোড়া মরে গেছে, খবরদার, ওটাকে নিয়ে টানাটানি কর না, যত তাড়াতাড়ি পার ওটাকে কবর দেবে [৭]।
সিলিকন ভ্যালিতে গুগলের মতো জায়ান্ট প্রতিষ্ঠান স্থাপনে এ ধরনের আইডিয়া চমৎকার; কিন্তু সবিনয়ে বলতে হয়, একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থা এমনই স্পর্শকাতর, সুদুরপ্রসারী এবং প্রভাবদায়ী বিষয় যে, সেখানে অপরীক্ষিত আইডিয়ার অপরিকল্পিত বাস্তবায়ন সবসময়ই নিষ্ঠুর ফল বয়ে নিয়ে আসে। বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে হুটহাট উদ্যোগের চেয়ে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবের কথা চিন্তা করে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। না হলে মৃত ঘোড়ার পর আমাদের হাতে থাকবে কেবলই শূন্য।
তথ্যসূত্র:
[১]-[৭] ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের লেখার লিংক: http://opinion.bdnews24.com/bangla/archives/22828
[২] সচলায়তনে ব্লগে ‘সমাপনী পরীক্ষা: কিছু প্রশ্ন ও প্রস্তাব’ শিরোনামে লেখার লিংক: http://www.sachalayatan.com/goutam/28800
[৩] প্রাথমিক শ্রেণির কারিকুলাম এখান থেকে ডাউনলোড করা যাবে: http://www.nctb.gov.bd/curriculam_downlaod.php
[৪] বাংলা বিষয়ে গবেষণাটির প্রতিবেদন ডাউনলোড করা যাবে এখান থেকে: http://research.brac.net/reports_details.php?scat=24&v=10&tid=509
[৫] গণিত বিষয়ে গবেষণাটির প্রতিবেদন ডাউনলোড করা যাবে এখান থেকে: http://research.brac.net/reports_details.php?scat=24&v=10&tid=513
[৬] শিশুদের কল্পনা নিয়ে কাইয়ুম চৌধুরীর বক্তব্যের লিংক: http://epaper.prothom-alo.com/contents/2014/2014_12_05/content_zoom/2014_12_05_32_0_b.jpg
* লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ-এর মতামত বিভাগে ১১ ডিসেম্বর ২০১৪ তারিখে।