* লেখাটি বাংলাদেশ শিক্ষা সাময়িকী-এর বর্ষ ১২, সংখ্যা ১, পৃ. ৩৫-৪২-এ প্রকাশিত হয়েছে।
ভূমিকম্পে আমাদের শিক্ষার্থীরা কতটুকু নিরাপদ
ভূমিকম্প যেখানে মানুষ তো বটেই, মানুষের চেয়ে হাজার-লাখ গুণ শক্তিশালী বড় বড় ভবন, গাছপালা ইত্যাদি অনায়াসে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়, সেখানে আলাদাভাবে শুধু শিক্ষার্থীদের কথা উল্লেখ করায় অনেকে অবাক হতে পারেন। কিন্তু এটি সত্য যে, ভূমিকম্প বা যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিশুরা– প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উভয়ভাবেই। ১৮ বছর (কিংবা নিদেনপক্ষে ১৬) বয়সের নিচে সবাইকে যদি শিশু মনে করা হয়, তাহলে দেখা যাবে, দুর্যোগ ও দুর্যোগ-পরবর্তী ধকলটি শিশু, নারী ও বৃদ্ধদের ওপর দিয়ে বেশি করে যায়। এ লেখায় নারী ও বৃদ্ধদের কথা আসবে না। যেসব শিশু লেখাপড়ার সঙ্গে যুক্ত অর্থাৎ যারা শিক্ষার্থী, ভূমিকম্পে তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।
বাংলাদেশ প্রায় প্রতি বছরই ছোট-বড় নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হচ্ছে– ভূমিকম্প ছাড়া। ভূমিকম্প এমন এক দুর্যোগ যা অনেক দিন হয় না, কিন্তু যখন হয় তখন সর্বনাশের চূড়ান্ত করে ছাড়ে। বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে যেহেতু সাম্প্রতিক সময়ে বড় ভূমিকম্প হয়নি, সুতরাং এ-এলাকায় একটি মাঝারি থেকে বড় ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে এবং সেটি হলে দেশটি শোচনীয়ভাবে ক্ষতির মুখোমুখি হবে। [১] শুধু বাংলাদেশই নয়, হিমালয় অববাহিকায় একাধিক ভূমিকম্পের কথাও বিভিন্ন গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে এবং যেসব টেকটোনিক সেট-আপ ও প্লেটের নড়াচড়ার কারণে ভূমিকম্প ঘটবে, সেই জোনের মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। [২][৩][৪]
সম্প্রতি নেপালের ভূমিকম্প গবেষকদের ধারণা সত্য প্রমাণ করেছে এবং আরও এ রকম বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। নেপালের ভূমিকম্পটির ঠিক সপ্তাহখানেক আগে বিভিন্ন দেশের বিশেষজ্ঞরা নেপালেই বসেছিলেন ভূমিকম্প নিয়ে করণীয় ঠিক করতে, কিন্তু সর্বনাশটি যে এত তাড়াতাড়ি ঘটে যাবে তা কেউ ধারণা করতে পারেননি। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ বলছেন, নেপালের বড় আকারের এই ভূমিকম্পের ফলে এ-এলাকায় বড় ভূমিকম্প সাম্প্রতিক সময়ে আর হবে না। অন্যদিকে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, ভূমিকম্প বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছুই বলা যায় না। সুতরাং এ বিষয়ে সাবধানতা অবলম্বন করাই ভালো।
চিত্র ১: যেসব ফল্টের কারণে বাংলাদেশ বড় ভূমিকম্পের কবলে পড়তে পারে [৫]
ভূমিকম্পের ব্যাপারে সবচেয়ে বড় অনিশ্চয়তা হচ্ছে, এটি কখন হবে তার কিছুই জানা যায় না। অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন, বন্যা, খরা, সাইক্লোন ইত্যাদিতে আগাম প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব, ভূমিকম্পে তেমনটি নয়। এখানে স্বল্পমেয়াদী প্রস্তুতির অপশন কম, নিতে হয় দীর্ঘমেয়াদী প্রস্তুতি। ভূমিকম্প দিনে হলে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা হবে এক রকম, রাতে হলে আরেক রকম। শিক্ষার্থীরা যখন বাড়িতে থাকে, তখন বড় ভূমিকম্প হলে তাদের পিতামাতা সবার আগে ছুটে গিয়ে নিজেদের প্রাণের বিনিময়ে হলেও সন্তানদের রক্ষা করবেন; কিন্তু তারা যখন বিদ্যালয়ে থাকে, তখন বড় ভূমিকম্প হলে কী করণীয়? বিদ্যালয়ের স্বল্পসংখ্যক শিক্ষক রক্ষা করবেন কজনকে? আমাদের বিদ্যালয়গুলো কি ভূমিকম্প মোকাবিলায় প্রস্তুত? ভূমিকম্পের সময় ও তার পরের করণীয় সম্পর্কে সচেতনতা রয়েছে কজন শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে?
চিত্র ২: মানচিত্রে ভূমিকম্পের জোন হিসেবে বাংলাদেশকে ভাগ করা হয়েছে। লাল জোন সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ, হলুদ জোনটি মাঝারি ও সবুজ জোনটি কম ঝুঁকিপুর্ণ [৬]
২০০৭ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে অনুভূত হওয়া ছোট থেকে বড় সব ভূমিকম্পের তালিকা থেকে দেখা যায়, এ-সময়ে দেশে ২৪ বার ভূকম্পন অনুভূত হয়েছে। এর মধ্যে ২০০৭ সালে ৬ বার, ২০০৮ সালে ১২ বার, ২০০৯ সালে। আমাদের দেশে একেক বিদ্যালয় একেক সময় শিক্ষাকার্যক্রম শুরু করে। সুতরাং সকাল সাতটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত বিদ্যালয়ের সময় বিবেচনা করলে দেখা যায়, এই ছয় বছরে বিদ্যালয়-সময়ে ভূমিকম্প হয়েছে মোট পাঁচবার।
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার (যেমন, United Nationals International Decade for Natural Disaster Reduction (UNIDNDR) মতে, বাংলাদেশ যে শুধু ভৌগোলিক কারণেই ভূমিকম্পের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে তা নয়; বরং জনসংখ্যার উচ্চ-ঘনত্ব, দুর্বল অবকাঠামোগত ব্যবস্থা, কম অর্থনৈতিক সক্ষমতা কিংবা দুর্যোগের পর উদ্ধারকাজ প্রক্রিয়ায় দুর্বলতা ইত্যাদি নানা কারণেও দেশটি ভূমিকম্প মোকাবিলার ঝুঁকিতে রয়েছে। Earthquake Disaster Risk Index (EDRI)-এর বিভিন্ন সূচক অনুসারে, বিশ্বের সর্বোচ্চ বিশটি ঝুঁকিপূর্ণ শহরের মধ্যে ঢাকা একটি।
এসব অবস্থা বিবেচনায় এবং সাম্প্রতিক নেপালের ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতির কথা মাথায় রেখে দেখা দরকার আমাদের দেশের বিদ্যালয়গুলোর ভূমিকম্প সক্ষমতা কতটুকু। বিদ্যালয়ে ভর্তির পর থেকে শিশুরা একটি বড় সময় কাটায় বিদ্যালয়ে এবং ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগ ওই সময়ে ঘটলে শিশুদের কীভাবে রক্ষা করতে হবে, তার পরিকল্পনা নেওয়ার সময় হয়েছে। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া বাংলাদেশের বিদ্যালয়গুলোতে সাধারণত দুর্যোগ মোকাবিলার আলাদা পরিকল্পনা নেই। হঠাৎ ঝড় উঠলে কী করতে হবে, আগুন লাগলে কী করা যাবে আর কী করা যাবে না, ভূমিকম্পে কীভাবে মাথা ঠাণ্ডা রেখে কোন কাজগুলো করতে হবে— এসব বিষয়ে শিক্ষার্থীদের হাতেকলমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় এমন বিদ্যালয়ের সংখ্যা হাতেগোণা। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) তাদের কাজের অংশ হিসেবে তাদের কর্মএলাকার বিদ্যালয়গুলোতে দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য ছোটখাট পর্যায়ে কাজ শুরু করেছে, কিন্তু তা নিতান্তই অপ্রতুল।
সারণি ১: ২০০৭ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমানায় অনুভূত ভূমিকম্পের বর্ণনা [৭]
ভূমিকম্পের প্রস্তুতি হিসেবে মূলত চারটি কাজ করতে হয়। এক. ভূমিকম্প হলে কী করা উচিত আর কী করা উচিত নয়, সে সম্পর্কে বছরে অন্তত দুবার প্রশিক্ষণ ও রিহার্সালের ব্যবস্থা করা। দুই. ভূমিকম্প-পরবর্তী সময়ের করণীয় বিষয়গুলো নিয়ে প্রতিনিয়ত আলোচনা করা। তিন. বিদ্যালয়ের পাশাপাশি শিশুর পরিবার ও সংশ্লিষ্ট কমিউনিটি সদস্যদের মধ্যে এসব বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করা। চার. বিদ্যালয়ের প্রতিটি ভবন যেন ভূমিকম্প-সহনীয় হয়, সেটি বিবেচনায় নিয়ে ভবনগুলো তৈরি করা।
এই চার করণীয়ের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন হল চতুর্থটি; কারণ এর জন্য প্রচুর শ্রম, অর্থ, সময় ও সততার প্রয়োজন। আমাদের দেশের অধিকাংশ বিদ্যালয়ের অবস্থাই করুণ। অনেক বিদ্যালয়ে ভাঙাচোরা ভবনে ক্লাস হয় যেগুলো সামান্য ঝড়েই নড়ে। ভূমিকম্পে সেগুলো সবার আগে ভেঙে পড়বে। এমনকি পরিত্যক্ত ভবনেও অনেক বিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম চলে। অনেক ক্ষেত্রে ইটের তৈরি ভবন থাকলেও সেগুলো সত্যিকার অর্থে কতটুকু মজবুত তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়।
এডুকেশন ওয়াচ ২০১৩ গবেষণা থেকে বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষগুলো কী রকম ঠিকঠাক আছে তার একটি ধারণা পাওয়া সম্ভব। নিচের সারণি থেকে দেখা যাচ্ছে, শতভাগ ঠিক আছে বাংলাদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এ রকম শ্রেণিকক্ষের সংখ্যা মাত্র ৪৪ শতাংশ এবং প্রায় ২৭ শতাংশ শ্রেণিকক্ষের অধিকাংশ অংশ ঠিকঠাক আছে। শ্রেণিকক্ষের অধিকাংশ অংশ ক্ষতিগ্রস্ত বা পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত এমন শ্রেণিকক্ষের সংখ্যা প্রায় ১১ শতাংশ।
উল্লেখ্য, শ্রেণিকক্ষ ঠিকঠাক আছে কিনা, তা নির্ধারণ করা হয়েছে জরিপকারীদের সরাসরি পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে। স্বাভাবিকভাবেই বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষগুলো ভূমিকম্প-সহনীয় কিনা তা এ-ধরনের জরিপের মাধ্যমে নির্ণয় করা সম্ভব নয়। এখানে শুধু বাহ্যিক বিষয় যা সাধারণভাবে দৃশ্যমান সেগুলো বিবেচনা করা হয়েছে। প্রশ্ন হল, যেখানে সাদা চোখে মাত্র ৪৪ শতাংশ শ্রেণিকক্ষকে পুরোপুরি ঠিক মনে হচ্ছে, সেখানে ভূমিকম্প-সহনীয়তার বিচারে সংখ্যাটি উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাবে না?
সারণি ২: বিভিন্ন ধরনের বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষের অবস্থা [৮]
সুতরাং দেশে যতগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে, তার ভবনগুলো নির্দিষ্ট মাত্রার ভূমিকম্প-সহনীয় কি-না তা জানা এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। আমাদের দেশে ভবন নির্মাণ বা এ ধরনের কাজে দুর্নীতি হয়, এটি মোটামুটি জানা কথা। সুতরাং গত কয়েক বছরে নতুন যেসব ভবন নির্মিত হয়েছে, সেগুলো সত্যিকার অর্থে ভবন নির্মাণের গাইডলাইন অনুসারে নির্মিত হয়েছে কিনা তা দেখা জরুরি। পুরনো ভবনগুলো প্রয়োজনে ভেঙেচুরে ঠিকঠাক করা প্রয়োজন। নেপালের ভূমিকম্পটির পর আগামী ১০ বা ১৫ বছরের মধ্যে যদি এ-এলাকায় এ রকম বড় ভূমিকম্প না হয়, তাহলে আমরা কিন্তু বেশ খানিকটা সময় পাচ্ছি। এই সময়টুকুতে আমাদের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিটি ভবন নিরাপদ করা প্রয়োজন।
তাছাড়া পরিত্যক্ত ভবনে শিক্ষাকার্যক্রম না চালিয়ে বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি। কারণ এ-ধরনের ভবনে দুর্ঘটনার জন্য ভূমিকম্পের প্রয়োজন হয় না, সামান্য ঝড়ো আবহাওয়াই যথেষ্ট হতে পারে। বিদ্যালয় ভবন নির্মাণকাজে একাধিক পক্ষ জড়িত থাকে। সব পক্ষ থেকে যদি সততার সঙ্গে কাজ করা হয়, তাহলে এই ভবনগুলোই শিশু ও এলাকাবাসীদের আশ্রয়স্থল হতে পারে। অন্তত শিশুদের কথা চিন্তা করে বিদ্যালয় নির্মাণকাজে সংশ্লিষ্টরা শতভাগ সততা ও প্রশ্নহীন দক্ষতা দেখাবেন, এই অনুরোধটুকু করতে চাই।
বাকি তিনটি কাজ তুলনামূলক সহজ। তবে এ জন্য প্রয়োজন সঠিক নির্দেশনা ও নির্দিষ্ট পরিকল্পনা। যেহেতু ভূমিকম্প এদেশের নিত্যনৈমিত্তিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়, সুতরাং এ-সম্পর্কে প্রশিক্ষণ গ্রহণ ও রিহার্সালের প্রয়োজনীয়তা অনেকের কাছে কম বা অপ্রয়োজনীয় মনে হতে পারে। বিশেষ করে পিতামাতা, গ্রামবাসী এমনকি বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও বিষয়টি কম গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে পারে। এ লেখকেরই এমন এক গবেষণায় এ ধরনের ফলাফল উঠে এসেছে। গবেষণাটিতে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, শিক্ষার্থী, শিক্ষক, পিতামাতা, গ্রামবাসী সবাইকে ভূমিকম্পের সচেতনতা বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে দেখা যায়, অধিকাংশই বিষয়টিতে গুরুত্ব দিতে চাননি। তাদের অনেকে এও বলেছেন, তাদের জন্মের পর থেকে এখন পর্যন্ত বড় ভূমিকম্প হতে দেখেননি। সুতরাং এ নিয়ে এত ভাবার কোনো কারণ নেই। এ থেকেই প্রমাণিত হয়, ভূমিকম্পের প্রস্তুতির ব্যাপারে আমাদের এক ধরনের উদাসীনতা বা অবহেলা রয়েছে— যেহেতু এটি নৈমিত্তিক দুর্যোগ নয়।
সুতরাং, এ ব্যাপারে সরকারি পর্যায় থেকে যেমন উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন, তেমনি বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে সঙ্গে নিয়ে বিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ তাদের বার্ষিক পরিকল্পনায় সচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করতে পারেন। স্থানীয় শিক্ষা প্রশাসনকেও এ ব্যাপারে নেতৃত্ব দিতে হবে। ভূমিকম্পের সময়ে এবং ভূমিকম্পের পরে কী কী করতে হয়, তা যদি শিশুদের ভালোভাবে শিখিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে তারা একদিকে যেমন তাদের পিতামাতাকে সচেতন করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে, তেমনি ভূমিকম্প হলে মৃত্যুঝুঁকিও কমানো সম্ভব।
এসব কাজে ব্যক্তি পর্যায়ে উদ্যোগ আশা করা বোকামি। বরং সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। স্থানীয় শিক্ষা অফিসসমূহের মাধ্যমে প্রতিটি এলাকায় বিদ্যালয় ভবন-সম্পর্কিত জরিপ করতে হবে। তাদের মাধ্যমেই সচেতন করতে হবে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের এবং তাদের মাধ্যমে তাদের অভিভাবক ও গ্রামবাসীদের। শহর ও গ্রাম এলাকায় ভিন্ন ভিন্নভাবে এই কর্মকাণ্ড চালাতে হবে। মূল দায়িত্ব কিন্তু সরকারের। সরকার যদি স্থানীয় মানুষের সহায়তা নেয়, তাহলে অবশ্যই এলাকাবাসী সহায়তা করতে কুণ্ঠিত হবে না।
বিদ্যালয়ে একেবারে ৪-৫ বছরের শিশু থেকে শুরু করে ১৮ বছর বয়সী শিশুরা পড়ালেখা করে। অন্তত বয়স ও তাদের মানসিক বিকাশের কথা যদি মাথায় রাখি, তাহলে বিদ্যালয় চলাকালে ভূমিকম্পে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে তারাই। নেপালের ভূমিকম্প আমাদের অন্তত এটুকু শিক্ষা দিয়েছে। ঢাকা, চট্টগ্রামের মতো বড় বড় শহরে তো বটেই, গ্রামেও আজকাল আমরা ভবন-কোড না মেনে ইচ্ছেমতো বাড়ি তুলছি। ভূমিকম্পে ঢাকা শহরে যে ক্ষতি হবে, তা কল্পনা করাও সম্ভব নয়। গ্রামে ক্ষতি তুলনামূলক কম হবে হয়তো, কিন্তু তার জন্য প্রস্তুতিতে ঢিল দেওয়ার সুযোগ নেই।
বিদ্যালয়ের ভবনগুলো একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় সহনীয় করা গেলে একদিকে নিরাপদ থাকা যাবে; অন্যদিকে শিক্ষার্থীসহ অন্যদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো গেলে ক্ষয়ক্ষতি কমানো যাবে।
তথ্যসূত্র:
[১] Khan, A.A., Hoque, M. Akhter. S.H., & Hoque, M.A. (2001). Earthquake in Bangladesh. A Natural Disaster and Public Awareness. The Journal of Noami.
[২] Bilham, R. (2004). Earthquake in India and the Himalaya: Tectonics, Geodesy and History. Annals of Geophysics, 47, N. 839-858.
[৩] Mukhopadhyay, B., Dasgupta, S. and Dasgupta, S. (2004). Clustering of earthquake events in the Himalaya – Its relevance to regional tectonic set-up. Gondwana Research 7(4): 1242-1247.
[৪] Mullick, M., Riguzzi, F. and Mukhopadhyay, D. (2009). Estimates of motion and strain rates across active faults in the frontal part of eastern Himalays in North Bengal from GPS measurements. Terra Nova 21(5): 410-415.
[৫] এই মানচিত্রটি Syed Humayun Akhter-এর Earthquakes of Dhaka লেখাটি থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। সূত্র: http://www.academia.edu/429823/Earthquakes_of_Dhaka
[৬] এই মানচিত্রটি নেয়া হয়েছে Geological survey of Bangladesh (GSB) থেকে।
[৭] http://earthquake.usgs.gov/earthquakes/eqarchives/epic/epic_rect.php ওয়েব সাইট থেকে ২০১৩ সালের ৩১ জুলাই তারিখে এই টেবিলটি তৈরি করা হয়েছে। টেবিলটি তৈরি করে দিয়েছেন বন্ধু মুহাম্মদ শাহাদাত হোসেন।
[৮] Nath, S.R., Roy. G, Rahman, M.H., Ahmed, K.S. and Chowdhury, A.M.R, (2013). New Vision Old Challenges: The State of Pre-primary Education in Bangladesh. Dhaka: Campaign for Popular Education.
* লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ-এর মতামত বিভাগে ১০ মে, ২০১৫ তারিখে।
বাজেট-পূর্ব আলোচনা: শিক্ষায় বরাদ্দ ও বাস্তবতা
জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশন শুরু হতে মাস দুয়েকও বাকি নেই। ইতোমধ্যে বিভিন্ন জায়গায় বাজেট-পূর্ব আলোচনা শুরু হয়েছে। অর্থমন্ত্রী ও তাঁর মন্ত্রণালয় বাজেট বিষয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছেন এবং বিভিন্ন মহলের দাবিদাওয়া শুনছেন। আগামী বাজেটে সম্ভাব্য কী কী পরিবর্তন আসতে পারে, সেসব নিয়ে বিভিন্ন মিডিয়ায় খবরও প্রকাশিত হচ্ছে।
বাজেট বলতে আমরা সাধারণত আয়-ব্যয়ের হিসাব-নিকাশই বুঝে থাকি; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বাজেটের পরিধি আরও ব্যাপক। যে কোনো বিষয়ে বাজেট মূলত ওই বিষয়ের ওপর পরবর্তী এক বছরে সরকারের কর্মকাণ্ডের একটি গাইডলাইন হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। সুতরাং কোনো নির্দিষ্ট সেক্টরে কী পরিমাণ টাকা বরাদ্দ করা হল এবং কতটুকু খরচ হল, তার বাইরেও বাজেট ওই নির্দিষ্ট সেক্টরে আগামী এক বছরে কী পরিবর্তন আসবে বা আসা প্রয়োজন তার একটি দিকনির্দেশনা প্রদান করে। ফলে বাজেট তৈরির কর্মকাণ্ড বা সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়গুলো মন্ত্রণালয়ের একার ওপর নির্ভর করে না; এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে সরকারের অন্যান্য মন্ত্রণালয়ও। কোন মন্ত্রণালয়ের কী কী চাহিদা রয়েছে এবং এসব চাহিদার মধ্যে কোনগুলো অগ্রাধিকার পেতে পারে তার প্রতিফলন দেখা যায় জাতীয় বাজেটে। সেই সঙ্গে সরকারের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির প্রতিফলনও মেলে বাজেটে।
জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ জাতীয় সংসদে গৃহীত হওয়ার পর থেকে আমরা যারা শিক্ষা সেক্টরে কাজ করি, তারা প্রতি বছরই জাতীয় বাজেটের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করি। এই আগ্রহের মূল কারণ হচ্ছে, জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ বাস্তবায়নের জন্য যে ধরনের বাজেট দরকার, গতানুগতিক শিক্ষার বাজেট সেটি পূরণ করতে পারবে না। সুতরাং সরকার নতুনভাবে বাজেটে শিক্ষাবিষয়ে কী ধরনের দিকনির্দেশনা দেয়, সেটির প্রতি আগ্রহ থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু বাস্তবতা হল, ২০১০ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত কোনো বাজেটকেই শিক্ষানীতি-বান্ধব বাজেট বলে অভিহিত করা যাচ্ছে না। গতানুগতিকভাবে প্রতিটি সরকার যেভাবে শিক্ষাবাজেট প্রদান করে, তারই প্রতিফলন দেখছি বিগত কয়েক বছরে।
বর্তমান শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন করতে গেলে বেশ কিছু বিষয়ে খুব দ্রুত পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। এর একটি হচ্ছে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার সময়সীমা বাড়ানো। বর্তমানে আইন অনুসারে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার মেয়াদ পাঁচ বছর যা বর্তমান শিক্ষানীতি অনুসারে আট বছর অর্থাৎ অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বিস্তৃত হওয়ার কথা। প্রায় পাঁচ বছর চলে গেলেও এ বিষয়ে তেমন অগ্রগতি চোখে পড়ছে না। এর আগে একবার বলা হয়েছিল, সরকার ২০১৮ সালের মধ্যে ধারাবাহিকভাবে এটি বাস্তবায়ন করবে; কিন্তু বাস্তবতা দেখে আশান্বিত হতে পারছি না। তাছাড়া দেশে সাক্ষরতার হার বাড়ানোর কথাও শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছে এবং এটি সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকারের বিষয়। এ ব্যাপারেও অগ্রগতি আশানুরূপ নয়।
আমাদের দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি অনুসারে কোনো এক সরকার যা করে পরবর্তী সরকার এসে তার খোলনলচে পাল্টে দেয়। বর্তমান শিক্ষানীতি এ দিক দিয়ে সৌভাগ্যবান যে, যে সরকার শিক্ষানীতি নিয়ে কাজ শুরু করেছিল, তারাই পরবর্তী সময়ে এসে তার বাস্তবায়নের কাজ শুরু করেছে। কিন্তু যে উদ্যম ও পরিসরে কাজটি হওয়ার কথা ছিল, সেটির বেশ অভাব দেখা যাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই, শিক্ষানীতি অনুসারে দেশের শিক্ষার বড় কোনো অংশ পরিবর্তনের জন্য মূল যে ভূমিকা পালন করবে, তা হচ্ছে বাজেটে শিক্ষার জন্য বরাদ্দ। বাজেটে যদি যথাযথভাবে বরাদ্দ না দেওয়া হয়, তাহলে যত উদ্যোগই নেওয়া হোক না কেন, তা মুখ থুবড়ে পড়বেই। ২০১০ সালের পর থেকে প্রতিবারই শিক্ষাসেক্টরে কর্মরত ব্যক্তিরা শিক্ষানীতি-বান্ধব বাজেটের কথা বলে আসছেন, কিন্তু কোনোবারই তার প্রতিফলন দেখা যায়নি।
অস্বীকার করার উপায় নেই যে, জাতীয় বাজেটে যে খাতগুলোতে সর্বাধিক বরাদ্দ দেওয়া হয়, শিক্ষা তার মধ্যে একটি। শিক্ষায় সর্বাধিক বরাদ্দ দেওয়াটা আমাদের বাজেটের একটি ঐতিহ্য। সব অর্থমন্ত্রীই শিক্ষায় সর্বাধিক বরাদ্দের কথা বলে কৃতিত্ব নিতে চান; কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ের বাস্তবতা ভিন্ন। এখন শিক্ষাখাতের চেয়ে সামরিক খাত বরাদ্দ বেশি দেওয়া হচ্ছে। শিক্ষাখাতে যে বরাদ্দ থাকছে, তার সঙ্গে আরও কিছু খাত জুড়ে দেওয়া। ফলে প্রকৃতপক্ষে শিক্ষাখাত সর্বাধিক বরাদ্দ পাচ্ছে না। সবচেয়ে বড় কথা হল, সর্বাধিক বরাদ্দ পাওয়া বা না পাওয়া এখানে আলোচ্য বিষয় নয়। শিক্ষানীতির জন্য প্রয়োজনীয় বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে কিনা, তা-ই মূলত আলোচ্য বিষয় হওয়া প্রয়োজন। সে দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে গত কয়েক বছরের শিক্ষাবাজেট থেকে হতাশ হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না।
আগেই বলা হয়েছে, বাজেট কেবল আয়-ব্যয়ের খতিয়ান নয়, এটি একটি দিকনির্দেশনামূলক ডকুমেন্টও বটে। শিক্ষানীতি প্রণয়নের পর বাজেট বক্তৃতায় শিক্ষানীতি অভিমুখে নানা ধরনের উদ্যোগ গ্রহণের কথা বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে এর দৃশ্যমান দিকনির্দেশনা দেখা গেছে কম ক্ষেত্রেই। ইতোপূর্বে বাজেট-পরবর্তী আলোচনায় দুয়েক জায়গায় শিক্ষামন্ত্রী নিজেও এ ব্যাপারে হতাশা প্রকাশ করেছেন। এটা অস্বীকারের উপায় নেই যে, অর্থমন্ত্রী চাইলেই অন্যান্য সব সেক্টরে টাকা কমিয়ে শুধু শিক্ষাখাতে বরাদ্দ দিতে পারবেন না। তাঁকেও সব মন্ত্রণালয়, সব সেক্টর ব্যালেন্স করে চলতে হয়। কোনো একটি নির্দিষ্ট সেক্টরে বেশি বেশি বরাদ্দ দেওয়া তাঁর কাজের আওতায় পড়ে না, পড়া উচিতও নয়।
সে সঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে যে, শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের কাজ বছরের পর বছর ধরে হয় না। একটি নির্দিষ্ট সময় ধরে– তা হতে পারে চার থেকে পাঁচ বছর– স্বাভাবিক বাজেটে ফেরত যাওয়া যায়। তাছাড়া বর্তমান সরকার যেখানে মানব উন্নয়ন ও মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষা অন্যতম একটি হাতিয়ার হিসেবে মনে করছে, সেখানে ধারাবাহিকভাবে কয়েকটি বছর গতানুগতিকতার বাইরে গিয়ে শিক্ষাবাজেট প্রণীত হতে পারে। এ দিক বিবেচনা করলে গত কয়েকটি বাজেট আমাদের হতাশা উপহার দিয়েছে।
এ প্রেক্ষিতে আসছে বাজেটে শিক্ষাবাজেট নিয়ে ভিন্নতরভাবে ভাবতে অর্থমন্ত্রীকে আহ্বান জানাতে চাই। বর্তমান শিক্ষানীতিতে বেশ কয়েকটি বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে যার মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষার পরিসর বাড়ানো, প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রসার, নারীশিক্ষার প্রসার, বিজ্ঞান শিক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ ইত্যাদি। সম্পদের সীমাবদ্ধতার কারণে সবকিছু যে একসঙ্গে বাস্তবায়ন করা যাবে না, তা আমরা সবাই উপলব্ধি করি। কিন্তু প্রতি বছর একটি একটি করে বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে বাস্তবায়নের দিকনির্দেশনা প্রদান করা যায়। তাতে সরকারের ওপর শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের চাপ একসঙ্গে না পড়ে কাজ কিছুটা কমে যায়।
একই সঙ্গে আমরা আগামী বাজেটে বর্তমান শিক্ষানীতির কোন অংশ কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে, তারও অগ্রগতির একটি হিসাব দেখতে চাই। এ অগ্রগতি কেন্দ্র করে পরবর্তী তিন বছরের জন্য কী ধরনের কৌশল গ্রহণ করলে শিক্ষানীতির সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তসমূহ বাস্তবায়ন করা যাবে, সে সম্পর্কে দিকনির্দেশনাও চাই বাজেট বক্তৃতা থেকে। আগামী বাজেটে একই সঙ্গে শিক্ষার জন্য বরাদ্দ ও দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্যে আশাবাদী হওয়ার মতো উপাদান থাকা জরুরি।
* লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ-এর মতামত বিভাগে ২৫ এপ্রিল ২০১৫ তারিখে।
প্রশ্নটি দক্ষতা ও আন্তরিকতার
চলমান এসএসসি পরীক্ষায় বিভিন্ন বোর্ডে বিভিন্ন বিষয়ের প্রশ্নপত্রে যেসব ভুলের খবর জানা গেছে একটি দৈনিক পত্রিকা থেকে, তাতে প্রথমেই যে প্রশ্নটি মনে জাগে – এসব প্রশ্নপত্র তৈরির সাথে যারা জড়িত ছিলেন, তাঁরা তাঁদের কাজে কতোটুকু দক্ষ ও আন্তরিক ছিলেন?
আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা পরীক্ষাকেন্দ্রিক। পড়ালেখা যা-ই হোক না কেন, পরীক্ষা হচ্ছে ঠিকঠাক সময়ে। পাবলিক পরীক্ষাগুলো ঠিক সময়ে যথাযথভাবে সম্পন্ন করা ও নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ফলাফল প্রকাশ করা – এ জায়গাটিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সত্যিকার অর্থে দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছে। তবে, দিনে দিনে এ বোধও জন্মাচ্ছে যে, আমাদের ছাত্রছাত্রীদের (এবং তাদের অভিভাবকদের) সমস্ত চিন্তাভাবনা এখন পরীক্ষার দিকে। শিক্ষকরা যখন পড়ান, তখন তাঁদেরও মনোযোগ থাকে পরীক্ষার দিকেই। সিলেবাস তো শেষ করতে হবে! শুনেছি, একেকটি বোর্ডের সাফল্য এখন নির্ধারিত হয় ওই বোর্ডের পাশের হার, সিজিপিএ পাওয়ার হার ইত্যাদি দিয়ে।
পড়ালেখায় পরীক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার; কিন্তু এরকম গুরুত্বপূর্ণ আরও অনেক বিষয় আছে। সেগুলোতে আমরা হালকা-পাতলা চোখ বুলিয়ে টর্চের সমস্ত আলো ফেলছি কেবল পরীক্ষার ওপর।
আগের বছরগুলো গেল প্রশ্নপত্র ফাঁসের টালমাতাল অবস্থায়। এ-দিক থেকে এবার অবস্থা ভালো। বলা যায়, সাফল্য এসেছে। যদিও রুটিন কাজকে সাফল্য বলা যায় কি-না, এ নিয়ে নানা বিতর্ক রয়েছে; কিন্তু প্রশ্নপত্র ফাঁসের যে অব্যাহত প্রক্রিয়ার মধ্যে ছিলাম, সেখান থেকে বেরিয়ে আসায় স্বস্তি এসেছে অনেকখানি। সংশ্লিষ্টরা এজন্য ধন্যবাদ পাবেন। কিন্তু, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা সম্ভবত ওই গরীবের মতো! পিঠের অংশ ঢাকতে গিয়ে পেটের কাপড় বেরিয়ে পড়ে।
অনেকেরই হয়তো জানা আছে, আমাদের একেকটি শিক্ষাস্তরে, যেমন, প্রাথমিক বা মাধ্যমিকে যে পরিমাণ শিক্ষার্থী আছে, সেই পরিমাণ জনসংখ্যা অনেক দেশের নেই। ফলে পাবলিক পরীক্ষার মতো বিশাল কর্মযজ্ঞ সুচারুভাবে সামলানো কম কষ্টের কাজ নয়! এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন দুটো বিষয়ের – এক, দক্ষতার ও দুই, আন্তরিকতার। একটির ঘাটতি থাকলেই বিপর্যয় ঘটতে বাধ্য।
প্রশ্নপত্রে ভুলের বিষয়টিতে সম্ভবত দুটোরই ‘অবদান’ আছে। যশোর বোর্ডে গণিতের প্রশ্নপত্রে ১১টি ভুল পাওয়া গেছে। চট্টগ্রাম বোর্ডের বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যম দুটো মিলিয়ে গণিতের প্রশ্নপত্রে ১১টি ভুল পাওয়া গেছে। ঢাকা বোর্ডের পদার্থবিজ্ঞানের প্রশ্নপত্রে পাঁচটি ভুল এবং রাজশাহী বোর্ডের বাংলা প্রথম পত্রের প্রশ্নপত্রে তিনটি ও দ্বিতীয়টিতে চারটি ভুল পাওয়া গেছে।
ভুল হতেই পারে – এই আপ্তবাক্য স্বীকার করে নেয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ। কিন্তু কোন পর্যন্ত? এর কি সীমা থাকা প্রয়োজন? এতোগুলো ভুল দেখে কি মনে হচ্ছে না যে, এগুলো নিছকই ভুল নয়; বরং স্রেফ মশকরা! কিছু নির্দিষ্ট মানুষকে প্রশ্নপত্র তৈরি করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তাঁরা নিশ্চয়ই এসব কাজে অভিজ্ঞ ও দক্ষ; না হলে তো এ-কাজে সুযোগ পেতেন না। যদি তাই হয়, তাহলে তাঁরা কি তাঁদের দক্ষতার প্রয়োগ ঘটাতে চেয়েছিলেন প্রশ্নপত্র তৈরির সময়? নাকি যেনতেনভাবে একটা কিছু তৈরি করে দায়িত্ব সেরেছেন? তাঁরা যদি দক্ষই হন, আন্তরিকই হন, তাহলে ধরে নিতে হবে প্রশ্নপত্র তৈরির ক্ষেত্রে তাঁরা মোটেই দক্ষতা ও আন্তরিকতার পরিচয় দিতে পারেননি। নিজেদেরকে অন্যায়কারী হিসেবে প্রমাণ করা ছাড়া এক্ষেত্রে আর কোনো দক্ষতা তাঁরা দেখাতে পারেননি।
(সম্ভবত) এর চেয়েও ‘করুণ মজার’ ঘটনা ঘটেছে ঢাকা, গাজীপুর, পটুয়াখালী, নীলফামারী, গোপালগঞ্জ ও যশোরের কিছু পরীক্ষাকেন্দ্রে। সেখানে শিক্ষকরা পরীক্ষা নিয়েছেন ২০১৪ সালের প্রশ্নপত্রে। দু’বছর আগের প্রশ্নপত্র কীভাবে সেখানে গেল সেটি এক রহস্য। পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র কীভাবে তৈরি, সরবরাহ ও বিলি হবে তার একটা নির্দিষ্ট নিয়ম আছে। প্রতিটি ধাপে দায়িত্বশীল একাধিক ব্যক্তি জড়িত থাকেন। পরীক্ষাকেন্দ্রের কক্ষ পরিদর্শক বা এই স্তরের শিক্ষকদের পক্ষে তো এসব প্রশ্নপত্র তৈরি বা বিলি করা সম্ভব না, যদিও তাদের অনেকেই শাস্তি পেয়েছেন। ২০১৪ সালের প্রশ্নপত্র বিলি হয়েছে কাদের উদ্যোগে, গলদটা শুরু হয়েছে কোথায় তা বের করতে পারলে হয়তো একটা ইন্টারেস্টিং গল্প জানা যেতে পারে। মূল ঘটনাটি কি জানা যাবে আদৌ?
এসব কাজে কতোটুকু দক্ষতার প্রয়োজন হয়? প্রয়োজন কতোটুকু আন্তরিকতার? খুব কি বেশি? যারা প্রশ্ন তৈরি করেন, তাঁরা তো সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞ। তাঁরা কি যেনতেনভাবে ভুল প্রশ্ন তৈরি করে জমা দেন রিভিউ, সম্পাদনা ও পরবর্তী অনুমোদনের জন্য? যারা প্রাথমিকভাবে তৈরিকৃত প্রশ্নপত্র পরে ঠিকঠাক করেন, তারা কি উক্ত প্রশ্নপত্রের ভুল ধরতে অক্ষম? উত্তরগুলো হ্যাঁ হলে তাঁদের দক্ষতা ও যোগ্যতার অভাবেরই প্রমাণ মেলে। আর না হলে বলতে হবে তাঁরা যেনতেনভাবে প্রশ্নপত্র তৈরি করে দিয়েছেন পরীক্ষার জন্য। বলতে হবে, মনোযোগ দিয়ে সুচারুরূপে প্রশ্নপত্র তৈরির মানসিকতা তাঁদের ছিল না।
এ-ধরনের কাণ্ড যে এই প্রথম ঘটলো তা নয়। এর আগেও, গত বছর, নোয়াখালীর একটি উপজেলার একটি কেন্দ্রে পৌরনীতি ও সুশাসন প্রথম পত্রের পরীক্ষায় দ্বিতীয় পত্রের প্রশ্ন দেওয়া হয়েছিল। পরীক্ষা নিয়ে সম্ভবত একটু খামখেয়ালীপনাই দেখিয়েছিলেন সংশ্লিষ্টরা।
কিন্তু এসবের ফল যাদের ভোগ করতে হচ্ছে, সেই শিক্ষার্থীদের কীভাবে ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে? পরীক্ষার হলে তারা যখন ভুল প্রশ্ন দেখে, তখন এসব ভুল প্রশ্নের কী উত্তর দিবে, আদৌ লিখবে কি-না, এরকম অনেকে দোটানায় ভুগতে হয় তাদের। বাড়তি মানসিক চাপের ব্যাপার তো রয়েছেই। পরীক্ষার হলের টেনশন ও বাড়তি চাপ ইত্যাদি মিলে অনেক শিক্ষার্থী স্বাভাবিক পরীক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়। কক্ষ পরিদর্শকরাও এ-সময় তড়িৎ সিদ্ধান্ত স্বাভাবিক কারণেই দিতে পারেন না। ফলে সময় নষ্ট হয় শিক্ষার্থীদের, তার পরীক্ষার গোটা পরিকল্পনাটাই হয়ে যায় উল্টাপাল্টা।
শিক্ষার্থীদের ক্ষতিপূরণের ব্যাপারে প্রচলিত অদ্ভুত সমাধানটিই বেছে নিয়েছেন কর্তাব্যক্তিরা। চট্টগ্রাম বোর্ড কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, বহুনির্বাচনী ভুল প্রশ্নগুলোর নম্বর সবাইকে দেওয়া হবে আর সৃজনশীল প্রশ্নগুলোতে যারা উত্তর লেখার চেষ্টা করেছে, তাদের নম্বর দেওয়া হবে। বাহ! এর চেয়ে তো সবাইকে গড়ে একটা নির্দিষ্ট নম্বর দিয়ে দেওয়াটাই ভালো। পরীক্ষার আর কী দরকার?
পরীক্ষা কেন নেওয়া হয় – এ প্রশ্নের উত্তর সবার জানা। নতুন করে ব্যাখ্যা প্রদান অনাবশ্যক। যে প্রশ্নগুলোতে ভুল আছে, সেগুলোর নম্বর যদি সবাইকে দিয়েই দেওয়া হয়, তাহলে পরীক্ষারই প্রয়োজন পড়ে না। ৪০টি প্রশ্নের মধ্যে ১১টি ভুল থাকলে সবাইকে এই ১১ নম্বর (মানে ২৭ শতাংশ) দিয়ে দিলে পাশ করার জন্য খুব বেশি খাটাখাটনি করার প্রয়োজন পড়বে না শিক্ষার্থীদের। বরং যারা পড়ালেখায় একটু পিছিয়ে পড়া, সেসব শিক্ষার্থী যদি প্রতিবছর প্রশ্নপত্রে এ-ধরনের ভুল হওয়ার আশা নিয়ে বসে থাকে, তাহলে তাদের মোটেই দোষ দেয়া যাবে না। ক্ষতিটা হবে যারা সত্যিকার অর্থে পড়ালেখা করেছে তাদের। এ ধরনের দুয়েকটি ঘটনাই পড়ালেখার প্রতি শিক্ষার্থীদের প্রেরণা ও প্রণোদনা হারানোর জন্য যথেষ্ট।
এ-ধরনের ঘটনার অবশ্য সুবিধাও আছে কিছু। যেহেতু ভুল হওয়া প্রশ্নগুলোর ক্ষেত্রে সবাইকে নম্বর দিয়ে দেওয়া হবে, সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষার্থীদের নম্বর যাবে বেড়ে। আর নম্বর বাড়লে তো পাশের হার, জিপিএ-র ইত্যাদিও বেড়ে যাবে অটোমেটিকভাবে। ‘সাফল্য’ও বাড়বে। ক্ষতি কী!
তবে এটি যেহেতু একটি সমস্যা, সুতরাং এ থেকে উত্তরণের উপায় বের করা প্রয়োজন। আবার উপায় বের করার আগে প্রথমে নির্ধারণ করা দরকার এখানে কোনটি মূল সমস্যা। প্রশ্নপত্রে ভুল এড়ানোর বিষয়টি মূখ্য হলে এর আলাদা কোনো সমাধান নেই। যার যার কাজ ঠিকমতো করলে এরকম হওয়া সম্ভব নয়। ইচ্ছাকৃত সমস্যার সমাধান হয় না।
অপরদিকে ভুল হওয়া প্রশ্নপত্রে শিক্ষার্থীদের ক্ষতিগ্রস্ত না করে কীভাবে তাদের নম্বর দেয়া যায় – এরও কোনো উত্তর থাকা উচিত না। কারণ ভুল সিস্টেম থেকে সঠিক ফলাফল বের করা যায় না।
যারা এসব কাজের সঙ্গে সম্পর্কিত, তাঁরা তাদের দক্ষতা ও আন্তরিকতা যাতে বাধ্য হয়ে হলেও প্রয়োগ করেন – সেটুকু নিশ্চিত করার কৌশলটাই শুধু বের করাটা প্রয়োজন, দ্রুত।
বইমেলা নিয়ে মৌসুমি সাতকাহন
মধ্যাহ্ন পার হয়ে বই মেলা এখন অস্তাচলের পথে। সময় যত যাবে, বিদায়ের করুণ সুর বাজতে থাকবে অনেকের মনে; পাশাপাশি বাড়তে থাকবে বেচাবিক্রির হার। মেলা শেষ হওয়ার পর প্রকাশকরা লাভক্ষতির হিসাব করবেন; কর্তৃপক্ষ আরেকটি সফল আয়োজনের দাবিদার হবেন; মিডিয়া হারাবে তিন কলাম পাঁচ ইঞ্চি ভরানোর মতো জায়গা কিংবা কয়েক মিনিট এয়ারটাইম এবং কিছু বিজ্ঞাপন। আর পাঠকবৃন্দ শুরু করবেন সদ্যকেনা নতুন নতুন বই পড়া।
একেকটি বই মেলা শেষ হওয়া মানে পরবর্তী বছরের মেলার জন্য নতুন করে প্রস্তুত হওয়া। শুধু কি তাই? সারা বছরের বই কেনাবেচার এবং এই কেনাবেচা কেন্দ্র করে লেখক-পাঠকের মিলনমেলার সবচেয়ে বড় উৎসব তো শুধু আর্থিক লাভ-ক্ষতির গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকে না! একেকটি বই মেলা জন্ম দেয় নতুন নতুন স্বপ্নের, উপহার দেয় নতুন ও প্রতিশ্রুতিশীল লেখক, পুরনো লেখকদের করে আরও ঋদ্ধ, বদলে দেয় পাঠকের পড়ার দিক ও দৃষ্টিভঙ্গি।
মেলা যদিও শেষ হয়নি, তারপরও বলা যায় দুয়েকটি ঘটনা ছাড়া বাংলা একাডেমি পরিচালনাগত দিক দিয়ে ভালো একটি মেলার আয়োজন করেছে। মেলা কর্তৃপক্ষের কাছে প্রকাশক ও পাঠকদের চাওয়া অনেক, কিন্তু সীমিত সামর্থ্যের মধ্যেও চাইলে অনেক কাজ সুন্দরভাবে করা যায়। এবার স্টলের আকার বেড়েছে, ধুলাবালির উৎপাত কম– এগুলোর জন্য কর্তৃপক্ষ নিশ্চয়ই ধন্যবাদ পাবেন। অনেক সময় ছোট ছোট কাজই পরিতৃপ্তির মাত্রা বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়।
মেলায় প্রবেশের সময় অনেক আঁকিয়ে এক রকম জোর করেই, বিশেষত শিশুদের হাতে-গালে শহীদ মিনার, পতাকা ইত্যাদি আঁকার চেষ্টা করে। প্রথম প্রথম উপভোগ্য হলেও এখন এটি বিরক্তিকর পর্যায়ে পৌঁছেছে। মেলার চেকিং গেট যেখানে শুরু, সেখান থেকে অনাহুত কাউকে ঢুকতে না দিলেই কিন্তু মেলার পরিবেশ আরেকটু পরিচ্ছন্ন হয়ে যায়। খেলনা-বাঁশি বিক্রি, পাইরেটেড বই বিক্রি, খাবার বিক্রি, আঁকাআঁকি সবই না হয় থাকুক মেলার বাইরে!
এ রকম ছোটবড় মিলিয়ে একটি বড় লিস্ট তৈরি করা যায় যেগুলো ঠিকঠাক করলে মেলা নিয়ে মানুষের ন্যূনতম অভিযোগ থাকবে না। আমরা তো অল্পতেই সন্তুষ্ট থাকি!
কেউ হয়তো প্রশ্ন করতে পারেন, মেলার শেষ পথে এ আলোচনা কেন? এর একটি বড় কারণ হল, আমাদের প্রায় সবকিছুই মৌসুমভিত্তিক। লেখালেখিটাও সে রকমই। বই মেলা ছাড়া অন্য কোনো সময়ে, সঙ্গতকারণেই, এ লেখা তৈরি হত না। লিখলেও পড়ার জন্য পাঠক পাওয়া যেত না কিংবা কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষিত হত না। এখনও যে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষিত হবেই, তা বলা যায় না; কিন্তু, ধারণা করি, মেলা শেষে একাডেমি কর্তৃপক্ষ মেলার সার্বিক আয়োজন নিয়ে মূল্যায়নে বসবেন এবং পরবর্তী বছরে বাড়তি কী কী করা যায়, তার একটি সুপারিশনামা বা নির্দেশনামূলক উপসংহারে পৌঁছাবেন। তখন বা তার আগে যদি এ ধরনের লেখা কর্তৃপক্ষের কাছে কোনোমতে পৌঁছে (কিংবা কোনো সহৃদয় পাঠক যদি একাডেমির নীতিনির্ধারক কারো কাছে পৌঁছে দেন), সে ক্ষেত্রে লেখাটি একটু হলেও কাজে লাগতে পারে বলে মনে করি।
সেটি মাথায় রেখে আগামীবারের বই মেলা আরও সুন্দর ও সফল করার প্রয়াসে কয়েকটি প্রস্তাবনা তুলে ধরছি। বলা বাহুল্য, এ-প্রস্তাবনা শুধু বাংলা একাডেমি কেন্দ্র করে নয়, বরং বই মেলা সফল করার প্রয়াসে আরও যারা জড়িত, সেই প্রকাশক ও পাঠক-ক্রেতাকে উদ্দেশ্য করেও (পরোক্ষ কিংবা প্রত্যক্ষভাবে) কিছু প্রস্তাব আছে এখানে।
প্রস্তাব ক.
বই মেলা দু’ভাগে ভাগ হয়ে যাওয়ার পর স্টলের আকার বেড়েছে। একাডেমি প্রাঙ্গনে শিশুদের জন্য প্রকাশনীগুলোর আর প্রতিষ্ঠানভিত্তিক স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে থাকে মূল প্রকাশকদের স্টলগুলো। প্রথম প্রস্তাবনা হচ্ছে, সবগুলো স্টলই উদ্যানে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হোক। এতে ক্রেতাদের একবার এদিকে, একবার ওদিকে ঘুরে বেড়াতে হবে না। এক জায়গাতেই সবগুলো স্টল পাওয়া যাবে। তাছাড়া চাইলে মেলার ক্ষেত্রও কিছুটা বাড়ানো যেতে পারে।
এখন যে আকারের স্টল বানানো হচ্ছে, তা স্বাভাবিক দিনের জন্য যথেষ্ট। কিন্তু বিশেষ দিন, যেমন, একুশে ফেব্রুয়ারি, পহেলা ফাল্গুন, ভ্যালেনটাইনস ডে, শেষের তিন-চার দিনের জন্য এটুকু জায়গা মোটেও যথেষ্ট না। উদ্যানে যেহেতু জায়গা আছে, সুতরাং মেলা কর্তৃপক্ষ স্টলগুলো আরেকটু বড় করার কথা ভাবতেই পারেন। তাছাড়া এখন প্রকাশকও তো অনেক ধরনের। পাইরেটর প্রকাশক, মেলাকেন্দ্রিক প্রকাশক ও মূলধারার প্রকাশক– সবাইকে সমমানে বিবেচনা করে স্টল বরাদ্দ না দিয়ে সত্যিকার বা মূলধারার প্রকাশকদের কিছুটা স্টল বরাদ্দে বাড়তি সুযোগ দেওয়া উচিত।
আরেকটি বিষয় এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন। বই মেলা দু’জায়গায় হওয়াতে দুটোকে বিচ্ছিন্ন আয়োজন মনে হচ্ছে অনেক সময়। এমন কোনো কিছু করা যেতে পারে কিনা, যাতে মনে হয় বাংলা একাডেমির মূল প্রাঙ্গন এবং উদ্যানের বই মেলা আদতে একটিই। কাজটি কীভাবে করা যায়, সে বিষয়ে একাডেমি কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনে পাঠকের কাছ থেকে আইডিয়া আহ্বান করতে পারেন।
প্রস্তাব খ.
স্টল বড় করার প্রস্তাবনার আরেকটি দিক রয়েছে। এখনকার পাঠকরা আগের চেয়ে বেশি সচেতন এবং দিন দিন সচেতনতার মাত্রা বাড়ছে। নির্দিষ্ট কয়েক জন লেখকের বই ছাড়া অন্য বই কেনার আগে পাঠকরা বইয়ের কিছু পৃষ্ঠা উল্টেপাল্টে দেখেন, সম্ভব হলে কিছুটা পড়েও দেখেন। বিশেষত প্রবন্ধ বা এ জাতীয় বইতে কী কী বিষয়ে লেখা আছে ভেতরে, তা ভালোভাবে দেখে তারপরই কেবল তা কিনতে চান। গড়ে একটি বই দেখতে যদি মিনিট তিনেক সময় লাগে এবং পাঠক যদি তিনটি বই দেখেন, তাহলে একটি স্টলে অন্তত দশ মিনিট সময়ের প্রয়োজন। কিন্তু বেশি পাঠক একসঙ্গে চলে এলে এতটা সময় থাকা যায় না। অনেক ক্ষেত্রে স্টলের কর্মীরাও এ ধরনের পাঠকদের নানাভাবে অনুৎসাহিত করেন। স্টলটি আরেকটু বড় হলে পাঠক আরও স্বস্তিতে বই দেখেশুনে কিনতে পারবেন।
প্রস্তাব গ.
স্টলের সাজসজ্জা ও কর্মীদের বিষয়েও প্রকাশকদের আরও ভাবা প্রয়োজন। প্রকাশকরা স্টলের বাহ্যিক সাজসজ্জার দিকে নজর দিচ্ছেন বেশি এবং পাঠকদের তা আকৃষ্টও করছে বেশ। বই মেলায় অনেক দৃষ্টিনন্দন স্টল দেখা যায়; কিন্তু বই কীভাবে সাজিয়ে রাখতে হয়, সে দিকে নজর প্রয়োজনের তুলনায় কম। যারা বিভিন্ন ধরনের বই প্রকাশ করেন, তারা একেকটি সারিতে একেক রকম বই রাখতে পারেন কিংবা একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে বই রাখতে পারেন যেখান থেকে পাঠকদের পক্ষে বই খোঁজা সুবিধাজনক হবে। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনবোধে লাইব্রেরি সায়েন্সে পড়ুয়া শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে।
অনেক স্টলে একই সঙ্গে উপন্যাস-গল্প-প্রবন্ধ ইত্যাদির বই এলোমেলোভাবে রাখা দেখেছি। তাছাড়া কোন বইটি পুরনো কিংবা কোনটি নতুন, তাও বোঝার উপায় নেই। প্রচ্ছদের কারণে কোনো কোনো বইয়ের নাম ও লেখকের নাম থাকে উপরে, কোনো বইয়ের নিচে– এগুলো মাথায় রেখে স্টল সাজালে তা পাঠকের জন্য সুবিধার হবে।
ক্রেতা বা পাঠকদের সঙ্গে স্টলের কর্মীরা কী ধরনের আচরণ করবেন, তাও ছোটখাট প্রশিক্ষণের বিষয়। প্রকাশকরা এ ব্যাপারে তাদের কর্মীদের বইমেলা শুরুর আগেই এক-দুদিনের প্রশিক্ষণ দিতে পারেন। অনেক ক্ষেত্রে দেখেছি, পাঠক কোনো বইয়ের নাম জিজ্ঞাসা করলে কর্মী অম্লান বদনে বলে দিচ্ছেন বইটি নেই। কিন্তু পরে খুঁজে দেখা যায়, বইটি সত্যিই ওই স্টলে আছে। এ ধরনের আচরণ একদিকে যেমন পাঠককে ওই প্রকাশনীর বই কিনতে অনুৎসাহিত করে, তেমনি তা প্রকাশনীর ইমেজের জন্যও ক্ষতিকর। তাছাড়া কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিক্রয় কর্মীদের রূঢ় ব্যবহারও করতে দেখা যায়।
অবশ্য এটিও উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, সব পাঠক এক রকম নন। বিক্রয় কর্মীরা প্রতিদিন অসংখ্য পাঠক সামলান। পাঠকও যদি নিজ ব্যবহারের প্রতি মনোযোগ দেন, তাহলে অনেক ঝঞ্ঝাট এড়ানো যায়। তবে বিক্রয় কর্মীদের মূল দায়িত্বই হচ্ছে সব ধরনের পাঠক সামলানো।
প্রস্তাব ঘ.
বাংলা একাডেমির মূল প্রাঙ্গনে বর্তমানে থাকা সব ধরনের স্টল বাদ দিয়ে সেখানে শুধু প্রতিদিনকার অনুষ্ঠান হবে। পাশাপাশি বই-সম্পর্কিত বিভিন্ন ধরনের প্রদর্শনীর আয়োজন করা যেতে পারে এই স্থানটিতে। উদাহরণস্বরূপ, একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষ্যে প্রকাশিত সবগুলো ‘একুশের সংকলন’ নিয়ে একটি বড় প্রদর্শনী করা যেতে পারে। কিংবা ভাষা আন্দোলনের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে এক বা একাধিক শিল্পীর আঁকা প্রদর্শনীও থাকতে পারে সেখানে। যদিও মূল আয়োজন বই মেলার। কিন্তু মেলার পাশাপাশি বাংলা একাডেমি যে অনুষ্ঠান করে প্রতিদিন, তার পাশাপাশি এ ধরনের আরেকটি আয়োজন মেলার মূল চেতনাকে ব্যাহত করবে না।
প্রস্তাব ঙ.
মূল প্রাঙ্গনে থাকতে পারে আরও একটি কিংবা একাধিক ভিন্ন ধরনের স্টল। বিভিন্ন প্রকাশনী প্রতি বছর বিভিন্ন বিষয়ের ওপর বই প্রকাশ করছে; কিন্তু সেগুলোর খবর একসঙ্গে জানা পাঠকের পক্ষে মুশকিল। অন্তত ফেব্রুয়ারি মাসে বই মেলা উপলক্ষ্যে প্রকাশ হওয়া নির্দিষ্ট কিছু ক্যাটাগরির বই নিয়ে এক বা একাধিক স্টল থাকতে পারে, যেখানে বই বিক্রি হবে না; পাঠক শুধু বইয়ের তথ্য জানতে পারবেন, বইটি হাতে নিয়ে নেড়েচড়ে দেখতে পারবেন।
উদাহরণস্বরূপ, বই মেলায় বিভিন্ন প্রকাশনী থেকে শিক্ষা ও শিক্ষা-সম্পর্কিত প্রবন্ধের কী কী বই প্রকাশিত হয়েছে, তা সম্পূর্ণভাবে জানা পাঠকের পক্ষে অসম্ভব। কোনো একক স্টল যদি থাকে মেলায় যেখানে কোনো প্রকাশনী এ বছর শিক্ষা বিষয়ে কী বই প্রকাশ করেছে, তা জানতে পারবে, তাহলে তার পক্ষে বই দেখা ও বাছাই করা সহজতর হয়। এভাবে অর্থনীতি-সমাজচিন্তা-শিল্পকলা-খেলাধুলা-ভ্রমণ ইত্যাদি নানা ক্যাটাগরির বই কেন্দ্র করে একাধিক স্টল হতে পারে মেলার মূল প্রাঙ্গনটিতে; কিংবা একটি বড় স্টলেই বিভিন্ন ক্যাটাগরির বই থাকতে পারে। পাঠক প্রয়োজনবোধে এখান থেকে বই দেখে পরে নির্দিষ্ট প্রকাশনীতে গিয়ে কাঙ্ক্ষিত বইটি কিনে নেবেন। প্রয়োজনে সেখানে পাঠকদের বসার জন্য একটি বড় জায়গা থাকবে, যাতে পাঠক বইটি কেনার আগে পড়তেও পারেন কিংবা না কিনলেও পড়তে পারেন।
কর্তৃপক্ষ অনুমোদন দিলে এ ধরনের স্টল প্রকাশকেরা যৌথভাবেই মেলার মূল প্রাঙ্গনে স্থাপন ও পরিচালনা করতে পারেন। এবার যেমন সোহরাওয়ার্দী অংশে প্যাভিলিয়ন স্টল বানানো হয়েছে, মূল মেলা প্রাঙ্গনে এ উদ্দেশ্যে প্যাভিলিয়ন স্টল বানানো হলে তা দারুণ কাজে আসবে বলে মনে করি।
প্রস্তাব চ.
একুশের বইমেলা নিয়ে বাংলা একাডেমির ওয়েব সাইটটি প্রতিনিয়ত আপডেট থাকা জরুরি হয়ে পড়েছে। এদিক দিয়ে একাডেমি অনেকটাই পিছিয়ে। কয়েক দিন আগেই পত্রিকায় খবর বেরিয়েছিল যে, একাডেমির ওয়েব সাইটে বই মেলার কোনো খবর নেই। সম্ভবত পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের পরই একাডেমি কিছুটা কাজ করেছে। এই লেখা যেদিন লিখছি (১৯ ফেব্রুয়ারি), সেদিন একাডেমির ওয়েব সাইটের বইমেলার খবরে বলা আছে: ‘‘এবারের গ্রন্থমেলায় এই পর্যন্ত মোট ২৯৮ টি বই প্রকাশিত হয়েছে।’’
অথচ প্রকৃত সংখ্যাটি অনেক বেশি। একাডেমির উচিত হবে এমন একটি ডেটা বেইজ তৈরি করা যা প্রতি মুহূর্তে আপডেট করা সম্ভব হবে এবং পাঠক (বিশেষত সাংবাদিকবৃন্দ) চাইলে ওই ডেটা বেইজ থেকে বই সম্পর্কে যে ধরনের তথ্য প্রয়োজন, যে কোনো সময় সে ধরনের তথ্য সংগ্রহ করতে পারবেন। আজকের দিনে এ ধরনের ওয়েব সাইট বানানো মোটেই কঠিন কাজ নয় এবং এতে খুব খরচও হয় না। অন্যদিকে, নতুন লেখকদের বই সম্পর্কে কীভাবে পাঠকদের বেশি বেশি জানানো যায়, তারও একটা প্রতিফলন থাকা উচিত একাডেমির ওয়েব সাইটে।
প্রস্তাবনা আরও আছে কিংবা বই মেলার উন্নতিকল্পে এরকম আরও প্রস্তাবনা দেওয়া সম্ভব, কিন্তু আপাতত এই ছয়টিতেই থামছি। মনে রাখা প্রয়োজন, বই মেলা শুধু বই কেনা-বেচার মেলা নয়, পাঠক সৃষ্টিরও এক বড় ক্ষেত্র। লেখক-পাঠক, লেখক-লেখক, পাঠক-পাঠক, পাঠক-প্রকাশক ইত্যাদি কম্বিনেশনে সম্মিলনের ক্ষেত্রও এই মেলা। সুতরাং একুশে বই মেলা পৌঁছে যাক নতুনতর উচ্চতায়, এই স্পৃহা সবার মাঝে থাকলে মেলার সর্বাঙ্গীন উন্নতি হবেই।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় আমরা কতোটুকু ‘শিক্ষিত’ হচ্ছি?
শিক্ষাবিজ্ঞানে যারা পড়ালেখা করেন, তারা শুরু থেকেই জানেন মানুষকে শিক্ষিত আর অশিক্ষিত বলে আলাদা করা যায় না বা করা ঠিক না। শিক্ষাবিজ্ঞানে পড়ালেখা না করাও অনেকে এটা জানেন, কিন্তু তাদের সংখ্যা বোধহয় কম। ফলে বিভিন্ন লেখা-আলোচনা-বক্তব্যে প্রায়ই ‘শিক্ষিত’ না হওয়ার খেদোক্তি শুনি। এই শিক্ষিত হওয়া বা না-হওয়ার ব্যাপারটা আসলে কী?
একজন মানুষ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পড়ালেখা করলে শিক্ষিত, না করলে অশিক্ষিত– এ-ধারণার কোনো ভিত্তি নেই। হয় এদিকে, না-হয় ওদিকে- এ ধরনের বিভাজন প্রায়ই মারাত্মক হয়। শিক্ষার ফলাফলকে বৃহত্তর অর্থে দুভাগে ভাগ করা যেতে পারে। এক. মানুষের মধ্যে মন্যুষত্ববোধ জাগ্রত হওয়া, নিজেকে পরিশীলিত করা এবং নিজেকে মানবিক ও সামাজিক গুণসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা। দুই. নিজের দক্ষতা ও যোগ্যতার বিকাশ ঘটানো।
উপর্যুক্ত সংজ্ঞার বিচারে একজন নিরক্ষর কৃষক বা জেলে যেভাবে নিজের কাজ দক্ষতার সঙ্গে করেন, তাতে তাদেরকে অশিক্ষিত বলার কারণ নেই। সুসজ্জিত অফিসে চাকুরিরত ডিগ্রিধারী ব্যক্তি নিজের কাজ যেভাবে সামলান, একজন কৃষজ বা জেলেও তার কাজ তার মতো করেই সামলান। একজনের কাজ আরেকজনকে দিয়ে করানো সম্ভব না। দক্ষতা ও যোগ্যতার বিচারে তাই কেউই অশিক্ষিত নন। অন্যদিকে মন্যুষত্ব, সামাজিক ও নানা ধরনের মানবিক গুণাবলীর বিচারে মানুষকে ভাগ করতে গেলে দেখা যায়- এসব বিষয়ের সাথে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সম্পর্ক যতোটুকু থাকা প্রয়োজন, সত্যিকার সম্পর্ক সে তুলনায় খুব কমই দেখা যাচ্ছে। ফলে একদিকে যেমন একজন মাস্টার্স বা পিএইচডি ডিগ্রিধারী ব্যক্তিকে ফাইল আটকিয়ে বিনা দ্বিধায় ঘুষ খেতে দেখা যায়, অন্যদিকে রিকশায় পড়ে থাকা লাখ টাকা ফিরিয়ে দেওয়া সৎ কিন্তু নিরক্ষর রিকশাচালকের সন্ধান মেলে হামেশাই। তো, এই বিচারে কে আসলে শিক্ষিত? শিক্ষার কাজই যদি হয় মন্যুষত্ব জাগ্রত করা, তাহলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা আসলে কতোটুকু কার্যকর?
সুতরাং মানুষকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ভিত্তিতে ‘শিক্ষিত’ আর ‘অশিক্ষিত’ হিসেবে ভাগ করাটা কোনোমতেই যৌক্তিক হয় না। মানুষকে বড়জোড় সাক্ষর আর নিরক্ষর- এ-ধরনের ভাগে রাখা যেতে পারে। কিংবা আরেকটু এগিয়ে গিয়ে ‘প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত’ এবং ‘প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত নয়’ – চাইলে এরকম ভাগও করা যেতে পারে। তারপরও চটজলদি কথা বা শব্দ হিসেবে আমরা মানুষকে ‘শিক্ষিত’ বা ‘অশিক্ষিত’ হিসেবে ভাগ করেই ফেলি। কাজটি ঠিক না হলেও শব্দগুলোর অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝতে সমস্যা হয় না। প্রশ্ন হলো- প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আমরা আসলে ‘শিক্ষিত’ হতে পারছি? কতোটুকু পারছি?
প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পড়ালেখার সাথে ‘শিক্ষিত’ হওয়ার এই বিষয়টা নিয়ে আলাপন প্রকৃতপক্ষে অনেক পুরনো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কিংবা জগদীশ চন্দ্র বসুর বিভিন্ন লেখা থেকে আমরা জানতে পারি, তাঁরা আজ থেকে শতবর্ষেরও অধিক আগে প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখার সাথে শিক্ষিত হওয়া বা না-হওয়ার সম্পর্ক খুঁজেছেন। বিশেষত পড়ালেখা করা অনেক তরুণ-যুবক যে সত্যিকার অর্থে শিক্ষিত হতে পারছে না, তাতে তাঁদের খেদ ভালোভাবেই প্রকাশিত হয়েছে। এ নিয়ে সে-সময়কার প্রাজ্ঞজনেরা তাঁদের অতীতের সাথে তুলনা করে বরং আক্ষেপই করেছেন।
আজকে যদি আমরা আমাদের সময়ের সাথে সেই সময়ের একটি তুলনা করি, তাহলে এই খেদ বাড়বে নাকি কমবে? ছোটখাট কিছু উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। শিক্ষা মানুষের মধ্যকার সহিষ্ণুতা বাড়ায়। আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে এদেশে ডিগ্রিধারী মানুষের সংখ্যা অনেক কম ছিল। নানা বিষয়ে তখনকার মানুষের সহিষ্ণুতার সাথে এখনকার মানুষের সহিষ্ণুতার তুলনা করলে আমরা কি আশাপ্রদ চিত্র পাবো? বিভিন্ন ধর্মীয় বা সামাজিক বিষয়াদিতে এদেশের তারকা ক্রিকেটাররা ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে যে পরিমাণ বিরূপ প্রতিক্রিয়া পান, তাতে কি মনে হয় না প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা আমাদেরকে যথেষ্ট পরিমাণে ‘শিক্ষিত’ করতে পারেনি? ভাইয়ের সাথে বোনের, স্বামীর সাথে স্ত্রীর ছবিও অনেকে ফেসবুকে আপলোড করতে পারেন না কদর্য মন্তব্যের কারণে। অনলাইন পত্রিকার কলামের নিচে মন্তব্যের ঘরে নোংরা মন্তব্যের ছড়াছড়ি কি আমাদের ‘শিক্ষিত’ হওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী করে? দিনের পর দিন শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকার উপরের দিকেই আমাদের অবস্থান। অথচ যে হারে ডিগ্রিধারী মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, এসব বিষয় তো সেই হারে কমে আসার কথা!
কিন্তু আসছে না। আসছে না বলেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সাথে ‘শিক্ষিত’ হওয়ার সহসম্পর্কটি প্রশ্নের মুখে পড়েছে। অনেকে হয়তো বলতে পারেন, আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রে এ সহসম্পর্ক কখনোই ছিল না। আগে তা প্রকাশের মতো যথেষ্ট প্ল্যাটফর্ম বা সুযোগ ছিল না, এখন অনলাইনে নানা প্ল্যাটফর্ম হওয়ায়, মানুষে-মানুষে যোগাযোগের বৃহত্তর সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় তা দিন দিন দৃশ্যমান হচ্ছে। এই যুক্তি মেনে নেওয়া যেতে পারে, যদিও ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ সেটিকে দ্বিধাহীনভাবে মেনে নিতে চায় না। কিন্তু যুক্তিটি মেনে নিলেও প্রশ্ন তোলা যেতে পারে, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ তো বিভিন্ন ধরনের নেতিবাচকতা কমানো। সেটি তাহলে কেন দৃশ্যমান হচ্ছে না?
আমাদের বর্তমান শিক্ষানীতির শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অংশে খুব সুন্দরভাবে কয়েকটি কথা লেখা আছে। সেখানে বলা হয়েছে:
শিক্ষানীতির মূল উদ্দেশ্য মানবতার বিকাশ এবং জনমুখী উন্নয়ন ও প্রগতিতে নেতৃত্বদানের উপযোগী মননশীল, যুক্তিবাদী, নীতিবান, নিজের এবং অন্যান্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, কুসংস্কারমুক্ত, পরমতসহিষ্ণু, অসাম্প্রদায়িক, দেশপ্রেমিক এবং কর্মকুশল নাগরিক গড়ে তোলা। পাশাপাশি শিক্ষার মাধ্যমেই জাতিকে দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার বৈশিষ্ট্য ও দক্ষতা অর্জন করতে হবে। এই শিক্ষানীতি সংবিধানের নির্দেশনা অনুযায়ী দেশে গণমুখী, সুলভ, সুষম, সর্বজনীন, সুপরিকল্পিত, বিজ্ঞান মনস্ক এবং মানসম্পন্ন শিক্ষাদানে সক্ষম শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার ভিত্তি ও রণকৌশল হিসেবে কাজ করবে। এই আলোকে শিক্ষার নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য, লক্ষ্য ও নীতিগত তাগিদ নিম্নরূপ :
…২. ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনে নৈতিক, মানবিক, সাংস্কৃতিক, বিজ্ঞানভিত্তিক ও সামাজিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠাকল্পে শিক্ষার্থীদের মননে, কর্মে ও ব্যবহারিক জীবনে উদ্দীপনা সৃষ্টি করা।
৩. মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করে তোলা ও তাদের চিন্তা-চেতনায় দেশাত্মবোধ, জাতীয়তাবোধ এবং তাদের চরিত্রে সুনাগরিকের গুণাবলীর (যেমন: ন্যায়বোধ, অসাম্প্রদায়িক-চেতনাবোধ, কর্তব্যবোধ, মানবাধিকার সচেতনতা, মুক্তবুদ্ধির চর্চা, শৃঙ্খলা, সৎজীবনযাপনের মানসিকতা, সৌহার্দ্য, অধ্যবসায় ইত্যাদি) বিকাশ ঘটানো।…
৫. দেশজ আবহ ও উপাদান সম্পৃক্ততার মাধ্যমে শিক্ষাকে শিক্ষার্থীর চিন্তা-চেতনা ও সৃজনশীলতার উজ্জীবন এবং তার জীবন-ঘনিষ্ঠ জ্ঞান বিকাশে সহায়তা করা।…
৭. জাতি, ধর্ম, গোত্র নির্বিশেষে আর্থসামাজিক শ্রেণী-বৈষম্য ও নারীপুরুষ বৈষম্য দূর করা, অসাম্প্রদায়িকতা, বিশ্ব-ভ্রাতৃত্ব, সৌহার্দ্য ও মানুষে মানুষে সহমর্মিতাবোধ গড়ে তোলা এবং মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে তোলা।…
৯. গণতান্ত্রিক চেতনাবোধ বিকাশের জন্য পারস্পরিক মতাদর্শের প্রতি সহনশীল হওয়া এবং জীবনমুখী বস্তুনিষ্ঠ ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি বিকাশে সহায়তা করা”। (জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০, পৃ. ১)
ভেবে দেখুন তো, কথায় কথায় আমরা যে ‘শিক্ষিত’ শব্দটি ব্যবহার করি, সেই শিক্ষিত হওয়ার কোনো বিষয়টি আমাদের বর্তমান শিক্ষানীতিতে কোথায় অনুপস্থিত? শুধু বর্তমান শিক্ষানীতিতেই নয়, এর আগেও যেসব নীতি বা শিক্ষা-বিষয়ক সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, সেগুলোতেও এসব অনেক ভালো ভালো কথা বলা হয়েছে এবং এসবের আলোকেই শিক্ষার নানা কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন করা হয়েছে। তাহলে ‘শিক্ষিত’ মানুষ প্রত্যাশিত হারে পাচ্ছি না কেন আমরা?
তাহলে কি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যর্থ? প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়া তো একটি রাষ্ট্র চলতে পারে না। আর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যর্থ হলে এর ফল হিসেবে সেই সমাজ ও রাষ্ট্রের ব্যর্থতার মুখে পড়ার কথা। শিক্ষার ফলে যে মনুষ্যত্ববোধ আমাদের জাগ্রত হওয়ার কথা, সেখানে কি আমরা সার্বিকভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছি? বিশেষ করে শিক্ষিতরা?
প্রশ্নগুলোর উত্তর বের করা জরুরি। জরুরি এ কারণে যে, শিক্ষা ছাড়া একটি সমাজ ও রাষ্ট্রের সার্বিক বিকাশ ও উন্নয়ন অসম্ভব। আর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সেখানেই সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে। এই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাই যদি গলদযুক্ত নাগরিক সৃষ্টি করে, তাহলে সমাজ ও রাষ্ট্রের যে সার্বিক উন্নয়নের কথা বলা হয়, সেটি আর সম্ভব হবে না।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যর্থতা ও ব্যর্থতার হার নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে; তবে সম্ভবত আমরা সবাই একমত হবো যে, বর্তমান প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় প্রত্যাশানুযায়ী ফল পাওয়া যাচ্ছে না। প্রত্যাশার সীমানা নির্ধারণ করে দিয়েছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনাগুলো; কিন্তু সে অনুসারে আমরা এগুতে পারছি কি? বর্তমান নিবন্ধটুকু এ প্রশ্নটি দিয়েই শেষ হোক, উত্তর খোঁজার প্রয়াস থাকবে পরবর্তী লেখায়।