গত সেপ্টেম্বরের ২ তারিখে বেসরকারি কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ঢাকায় এসে এমপিওভুক্তির দাবিতে পুনরায় আন্দোলন শুরু করেছেন। এর আগেও একবার তাঁরা ঢাকায় আন্দোলন করেছিলেন এবং সেসময় বিভিন্ন ধরনের আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁদের আন্দোলন সেপ্টেম্বরের ১ তারিখ পর্যন্ত স্থগিত রাখা হয়েছিল। সম্ভবত তাঁদের আশা ছিল- সরকার নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এমপিওভুক্তির দাবি মেনে নেবে। রাস্তাঘাট অবরোধ করে বা এ ধরনের কর্মসূচি দিয়ে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করে আন্দোলন করাটা আইনের চোখে অপরাধ কিনা জানি না; তবে মানুষজন আজকাল এ ধরনের কর্মসূচি ভালো চোখে দেখে না। অন্যদিকে এদেশে যতোক্ষণ না মানুষজন রাস্তায় নামছে ততোক্ষণ তাদের কথা সরকার কানে তুলে না। সেপ্টেম্বরের ১ তারিখ পর্যন্ত স্থগিত আন্দোলন তাই স্বাভাবিকভাবেই দুই তারিখ থেকে নতুনভাবে শুরু হয়েছে। তার বেশ কিছু আগের আন্দোলনে শিক্ষকরা রাস্তা অবরোধ করেছিলেন শাহবাগে। সরকারের পুলিশ বাহিনী বীরত্ব দেখিয়েছিল শিক্ষকদের পিটিয়ে। অবশ্য এবার পুরোপুরি রাস্তা অবরোধ না করে শিক্ষকরা প্রেসক্লাবে রাস্তার পাশে শুয়ে-বসে আন্দোলন চালাচ্ছেন। সরকার তাঁদের দাবি কতোটুকু শুনছে বা শুনলেও আদৌ পাত্তা দিচ্ছে কিনা জানি না- কিন্তু দু’দিন পর পর শিক্ষকদের এসব আন্দোলন মানুষের মনে এই বার্তাটা দিচ্ছে যে, সরকার শিক্ষক সমাজের দাবিদাওয়ার প্রতি উদাসীন। বিশেষত মাত্র কিছুদিন আগে শাহবাগে পুলিশের দ্বারা একজন বয়স্ক শিক্ষককে পিটুনির ঘটনাটি বিভিন্ন সামাজিক নেটওয়ার্কিং ওয়েব সাইটগুলোতে যেভাবে ধিকৃত হয়েছে, তাতে সরকার শিক্ষকদের প্রতি আন্তরিক নয় এমনটা অনেকে মনে করতে পারেন।
এমপিওভুক্ত নন এমন শিক্ষকদের পেশকৃত দাবিদাওয়ার পিছনে অনেক কারণ আছে। শিক্ষকতা পেশাকে আমরা যতোই মহিমান্বিত করি না কেন, আমাদের, বিশেষত সরকারের মনে রাখা দরকার তাঁদের পেট আছে, পাকস্থলী আছে। শিক্ষকদের পরিবার আছে, তাদের খাবার-পোশাক-দৈনন্দিন জীবন যাপনের উপাদান কিনতে হয়। একজন শিক্ষক সারাদিন শিক্ষার্থীদের পড়িয়ে বাড়ি গিয়ে যদি দেখে তাঁর নিজের সন্তানের ন্যূনতম চাহিদাগুলো পূরণ করতে পারছেন না; তখন পরদিন তিনি বিদ্যালয়ে কী পড়াবেন, তা সহজেই অনুমেয়। লজ্জাজনক বেতন-কাঠামো নিয়ে একজন শিক্ষক যখন প্রাইভেট পড়ান, তখন আমরা অনেকেই উচ্চকণ্ঠ হই; কিন্তু তার পেছনে শিক্ষকদের যে করুণ-কাহিনীগুলো যুক্ত থাকে, সেগুলো জানার আগ্রহ সেই তুলনায় অনুপস্থিত। সুতরাং শিক্ষকরা যদি কিছু সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর দাবি করে, সেগুলোকে আলাদাভাবে মানবিক দিক দিয়ে বিবেচনা করার দরকার নেই; যৌক্তিকভাবে তাঁদের দাবিদাওয়া যুক্তিসঙ্গত কিনা, সেটা দেখলেই চলে।
বর্তমান মহাজোট সরকারের সবচেয়ে বড় দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নির্বাচন-পূর্ব নানা বক্তব্যে অনেককিছু করার অঙ্গীকার করেছিল। অনেকক্ষেত্রে সুস্পষ্ট অঙ্গীকার না করলেও সেগুলো সমাধানের ইঙ্গিত ছিল তাদের বক্তব্যে- দলের নেতৃবৃন্দ এসব কথা কোন বিবেচনায় বলেছিলেন জানা নেই। কিন্তু দলের পক্ষ থেকে যে অঙ্গীকারগুলো করা হয়েছিল সেগুলো যে জেনেবুঝে করা হয় নি, তা দিন দিন পরিষ্কার হচ্ছে। শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো সেসব অঙ্গীকারেরই একটি। শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ একসময় গণমানুষের রাজনীতি করেছেন, শিক্ষকদের সঙ্গে মিশেছেন। তাঁদের দাবিদাওয়ার প্রতি তিনি একজন মানুষ হিসেবে যেমন সচেতন, ধারণা করি একজন মন্ত্রী হিসেবেও তিনি সেসব ব্যাপারে অনেক বেশি দায়িত্ববান। শিক্ষকদের জন্য দৃশ্যমান কিছু কাজ করার চেষ্টাও করেছেন তিনি কিন্তু সেই শুরু থেকেই এমপিওভুক্তির ঝামেলা এড়াতে পারেন নি। সরকার ২০১০ সালে যখন কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করার উদ্যোগ নেয়, তখন তিনি চমৎকারভাবে একটি নীতিমালার মধ্য থেকে এমপিওভুক্তির জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্বাচন করেছিলেন। এই তালিকা পরবর্তী সময়ে দলীয় বাধার মুখে পরিত্যক্ত হয়। বঙ্গবন্ধুর নামকরণে রাখা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কেন বাদ পড়লো- এই অভিযোগও তাঁকে শুনতে হয়েছে। কারণ নীতিমালার মধ্যে বঙ্গবন্ধুর নামকরণ-সম্পর্কিত কোনো বিষয় ছিল না। পরবর্তীতে জনাব নাহিদের নির্দেশনা অনুযায়ী তালিকার অনেক রদবদল হলেও তিনি অন্তত একটি নীতিমালা তৈরি করে সেটি অনুসরণের যে রীতি প্রচলন করেছিলেন, তা মানুষের কাছে প্রশংসিত হয়েছিল।
কিন্তু ওটাই শুরু, ওটাই শেষ। এর পর এমপিওভুক্তি নিয়ে নানা জটিলতা হয়েছে যেগুলো অনেকে হয়তো জানেন না। প্রথম বছর এক হাজার ৬১২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করার পর অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্ষোভ মেটাতে সরকার ঘোষণা করেছিল এর পর থেকে প্রতি বছরই নতুন নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হবে। আদতে সেটা হয় নি একেবারেই। এমপিওভুক্তির যে নীতিমালা রয়েছে, সে অনুযায়ী দেশে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষক রয়েছেন যারা এমপিওভুক্তির দাবিদার। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে এমপিওভুক্তির কাজকর্ম না চালানোয় এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষক এমপিওভুক্তির সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। পাশাপাশি প্রচুর নতুন শিক্ষক আছেন যারা শিগগিরই এমপিওভুক্ত হওয়ার কাতারে চলে আসছেন। অপরদিকে ২০১১ সালে অনেক ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের টাইমস্কেল চালু করা হলেও তা জুন থেকে বন্ধ করে দেয়া হয়। এমপিওভুক্তি না করা বা এসব সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করার পিছনে পর্যাপ্ত টাকা না থাকার কথা বারবার বলা হলেও ২০১১-১২ অর্থবছরে এমপিওর জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ থেকে ২৮ কোটি ৮০ লাখ টাকা অর্থ মন্ত্রণালয়ে ফেরত গেছে বলে পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে। তাহলে সমস্যাটা কোথায়?
সরকার হয়তো বলবে, শিক্ষক সংগঠনগুলো বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নানা সময় সরকারের কাছে দাবিদাওয়া পেশ করলে সরকার সবক্ষেত্রে নীরব থাকছে না। সম্প্রতি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সরকারিকরণের প্রক্রিয়ায় আনা হচ্ছে বলে যে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে তাতে শিক্ষকরা হয়তো এটুকু আশ্বস্ত হবেন যে, সরকার অল্পকিছু হলেও করছে। কিন্তু এমপিওভুক্তির ক্ষেত্রে যে বেড়াছেড়া লেগেছে, সেটা যেন কিছুতেই কাটতে চাইছে না। একজন শিক্ষক যখন তাঁর শিক্ষা-কার্যক্রম ছেড়ে দাবি আদায়ের লক্ষ্যে রাজপথে শুয়ে থাকেন, তখন সরকারের কাছে চটজলদি আলোচনা করে এর সমাধান খুঁজে বের করার বিষয়টি যে কোনও অর্থেই প্রাধান্য পাওয়া উচিত। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার কথা সরকার কিছু দিন পরপরই উচ্চারণ করে; শিক্ষকদের বঞ্চিত রেখে মানসম্পন্ন শিক্ষা কীভাবে সরকার নিশ্চিত করবে? বর্তমান আন্দোলনের অগ্রভাবে থাকা বাংলাদেশ বেসরকারি শিক্ষক কর্মচারী পরিষদ এবং নন-এমপিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্যজোটের নেতারা দাবি করছেন, সরকার তাঁদের দাবিদাওয়ার ব্যাপারে আন্তরিক নয়। বিশেষ করে নিম্ন-মাধ্যমিক, মাধ্যমিক, মাদ্রাসা, কলেজ, কৃষি ডিপ্লোমা ইনস্টিটিউট, ব্যবসায় ব্যবস্থাপনা কলেজ, ভোকেশনালসহ কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হওয়ার যোগ্য। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের ফাইল চালাচালি, সরকারের উদাসীনতা, দুর্নীতি, বাজেট না থাকার অজুহাত ইত্যাদি নানা কারণে এ কাজগুলো হচ্ছে না।
শিক্ষাবান্ধব শিক্ষামন্ত্রী থাকা সত্ত্বেও সরকার যেটুকু কাজ করছে শিক্ষকদের জন্য সেটুকু আসলে কোনো বিচারেই যথেষ্ট নয়। রাজনৈতিক বিবেচনা, দুর্নীতি বা ফাইল চালাচালির কারণে এমপিওভুক্তির বিষয়টি থেমে থাকা সরকারের অযোগ্যতাকেই নির্দেশ করে। সরকারের উচিত একটি নির্দিষ্ট নীতিমালা অনুসরণ করা যার ভিত্তিতে যোগ্য শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেন নিয়মিতভাবে এমপিওভুক্ত হতে পারে। সরকারের পক্ষ থেকে যারা বাজেট সংকীর্ণতার দোহাই দেন, তাঁরা সম্ভবত ভুলে যান যে, বাজেটের বিষয়টি পুরোপুরি নির্ভর করে সরকারের নিজস্ব মেকানিজমের ওপর। কোন খাতে কতোটুকু বাজেট বরাদ্দ করা হবে, তা সরকার চাইলেই ঠিক করে দিতে পারে। বাজেট বক্তৃতার পর যদিও অর্থমন্ত্রী বড় গলায় শিক্ষাবাজেটে সর্বোচ্চ বরাদ্দের দাবি করেন, কিন্তু বাস্তবতা হলো শিক্ষাখাতের খাতে অন্যান্য আরও খাত জুড়ে দেয়া হয়- ফলে সেটা বড় দেখা যায়। প্রকৃতপক্ষে শিক্ষাখাতের চেয়ে সামরিক খাতে ব্যয় বেশি সরকারে, ব্যয় অন্য অনেক অপ্রয়োজনীয় ক্ষেত্রেও। শিক্ষাখাতে বড় বাজেট দেখানো সরকারের ফ্যাশন, এই ফ্যাশন না দেখালে বদনামের ভাগিদার হতে হয় কিন্তু বাংলাদেশে শিক্ষাবাজেট প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। অন্য দেশের সঙ্গে তুলনায় না হয় না-ই গেলাম, কিন্তু ইউনেস্কো জাতীয় বাজেটের অন্তত আট শতাংশ শিক্ষাখাতে রাখতে পরামর্শ দেয়। আমরা যদি এর অন্তত অর্ধেকও বরাদ্দ করতে পারতাম, তাহলে আজকে শিক্ষকদের রাস্তায় শুয়ে থাকতে হতো না। দুঃখের বিষয়, আমাদের অর্থমন্ত্রী মোটেই শিক্ষাবান্ধব নন। শিক্ষকদের এসব দাবিদাওয়ার কথা বাদ দিয়েও যদি বলি, সরকারের নতুন শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের জন্য প্রতিবছর যেটুকু টাকা দরকার, অর্থমন্ত্রী সেটুকুও দিতে রাজি নন। কে জানে, হয়তো খোদ সরকারের নীতিনির্ধারকরাই শিক্ষাক্ষেত্রে এই বরাদ্দ দিতে রাজি নয়, শিক্ষানীতি কেবলই একটি আইওয়াশ! শিক্ষার জন্য, শিক্ষকদের জন্য সরকারের আলাদা দরদ থাকার কোনোই দরকার নেই, যুগের চাহিদার সঙ্গে তাল মেলানোর জন্য যতোটুকু বরাদ্দ করা দরকার, ততোটুকু বরাদ্দ করলে এসব সমস্যা নিয়ে প্রতিবছর কথা বলতে হয় না। আর এমপিওভুক্তি নিয়ে যে জটিলতা এখন দৃশ্যমান, সেটুকুর দায় পুরোপুরি সরকারের। অনর্থক জটিলতা ডেকে আনতে এ সরকার যথেষ্ট দক্ষতা দেখাচ্ছে, এটিও তার বাইরে কিছু নয়।
Leave a Reply