স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন জানিয়েছেন, ঢাকার ব্যস্ত রাস্তা থেকে পর্যায়ক্রমে রিকশা উঠিয়ে দেওয়া হবে। রিকশা উঠিয়ে দেওয়ার কারণ হিসেবে তিনি মূলত যানজটের কথা উল্লেখ করেছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এ উক্তির মাত্র দুদিন আগে ঢাকার রাস্তায় রিকশাচালকরা ধুন্ধুমার কাণ্ড করেছে। রামপুরা-মগবাজার-মৌচাক ব্যস্ত সড়কে রিকশা চলাচল বন্ধের প্রতিবাদে তারা সংঘবদ্ধ হয়ে রাস্তা অবরোধ করেছে, গাড়ি ভাংচুর করেছে। পরদিন ভাঙা গাড়ির আরোহী, কান্নারত ও ভয়ার্ত এক শিশুর মানবিক আবেদন-সমৃদ্ধ ছবি ছাপা হয়েছে প্রায় সবকটি শীর্ষ দৈনিকে। এ ছবি দেখে নাগরিক সমাজ স্বভাবতই বিহ্বল হয়েছেন; বোধকরি কান্নারত শিশুর জায়গায় নিজের কিংবা পরিচিত কোনো শিশুর মুখাবয়ব কল্পনা করে শিউরেও উঠেছেন।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকার ব্যস্ত রাস্তা থেকে রিকশা উঠিয়ে দেওয়ার যে সিদ্ধান্ত জানালেন, সেটি নিয়ে কিছু বলার আগে প্রাসঙ্গিক কয়েকটি কথা বলা দরকার। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে, রাজধানী ঢাকার ব্যস্ততম সড়কগুলোতে ভিন্ন গতিসম্পন্ন বাহন চলা কোনোভাবেই উচিত নয়। একাধিক গতিসম্পন্ন বাহন প্রকৃতপক্ষে সব ধরনের বাহনেরই গতি কমিয়ে দেয়। এমনকি সবচেয়ে বেশি গতিসম্পন্ন গাড়ি যে লেনে চলার কথা, সেই লেনে যদি অন্য লেনের তুলনামূলক কম গতির গাড়ি চলে আসে, তাও যান চলাচলের স্বাভাবিক গতিকে বিনষ্ট করে দিতে পারে। যানজট-সংক্রান্ত নানা আলোচনায় বিশেষজ্ঞদের বলতে শুনেছি, চওড়ার দিক দিয়ে অন্য শহরের রাস্তার তুলনায় ঢাকায় রাস্তার পরিসর খুব একটা কম নয়। কিন্তু সেসব দেশে যে লেনে যে বাহনের চলার কথা, সেই লেনেই সেই বাহনটি চলাচল করে। এই জায়গাতে ঢাকা চরমভাবে ব্যতিক্রম বলে যানজটের মাত্রা ও বহুমুখীতা এখানে তুলনামূলকভাবে বেশি।
এ অবস্থায় স্বল্পগতিসম্পন্ন রিকশা ঢাকার ব্যস্ত সড়কের জন্য পুরোপুরিই বেমানান। কিন্তু ঢাকার পরিবহনে রিকশা একটি চরম বাস্তবতা। ব্যস্ত রাজধানীতে রিকশা চলাচল ঠিক কিনা, সে নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে প্রচুর তর্ক চলতে পারে; কিন্তু গণপরিবহনের অপ্রতুলতার কারণে রিকশা বাদ দিয়ে ঢাকাকে চিন্তা করা নির্বুদ্ধিতা। হতে পারে রিকশা অস্বাভাবিক কম গতির। হতে পারে একজন মানুষের আরেকজনকে টেনে নিয়ে যাওয়াটা সৌখিন মানবতার জন্য অবমাননাকর। কিন্তু সামগ্রিকভাবে ঢাকার পরিবহন ব্যবস্থার বাস্তবতা অনুধাবন করতে গেলে রিকশাকে গোণায় ধরতেই হয়।
এবারই প্রথম নয়; প্রায় প্রতিবছরই নিয়ম করে ঢাকার একেকটি রাস্তা থেকে রিকশা উচ্ছেদ করা হয়। রিকশাচালকরা এক-দুদিন প্রতিবাদ করে, ভাঙচুর করার সংস্কৃতি ইনবিল্ট থাকায় বেশ কিছু ভাঙচুরও করে; কিন্তু শেষ পর্যন্ত সরকারি সিদ্ধান্তের কাছে নতি স্বীকার করে আগের চেয়ে চুপসানো এলাকায় সেই রিকশাই চালাতে থাকে। দিন যায়, রিকশা চালানোর এলাকা সীমাবদ্ধ হতে থাকে; রিকশাচালকদের প্রতিবাদেও বাড়তে থাকে জঙ্গীত্ব। গত ২৮ মার্চে রিকশাচালকরা রাজপথে যে তাণ্ডব চালিয়েছে, সেটি সম্ভবত এ সময়কালে রিকশাচালকদের সবচেয়ে নির্মম, নিষ্ঠুর ও ভয়ংকর প্রতিবাদ। সরকার এ ঘটনায় কিছুটা বেশি বিহ্বল হয়েছে সম্ভবত এ কারণে যে- সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেননের উদ্ধৃতি অনুসারে, “রিকশাচালকেরা মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সভাপতির মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে, অথচ আমরা কিছুই করতে পারিনি”। আগামীতে নতুন কোনো রাস্তায় রিকশা চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কম তৎপর থাকলে রিকশাচালকদের নৃশংসতা যে এর চেয়ে ভয়াবহ হবে না, তা উড়িয়ে দেয়া যায় না।
আমি ব্যক্তিগতভাবে ঢাকার প্রধান সড়কগুলোতে রিকশা চলাচলে পক্ষপাতী নই। রিকশা চলবে অপেক্ষাকৃত সরু রাস্তায়, পাড়ার গলিতে। কিন্তু তাই বলে কোনো পরিকল্পনা কিংবা আগাম নোটিশ ছাড়া হুট করে একেক সময় একেক সড়ক থেকে রিকশা উঠিয়ে দেওয়ারও পক্ষপাতী নই। রিকশা উঠিয়ে দেওয়ার আগে পরিবহন ব্যবস্থা ও নাগরিক জীবনে এর প্রভাব, সুষম গণপরিবহন ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ, নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তের ব্যয়বৃদ্ধি, রিকশাচালক ও তাদের পরিবারের রুটিরুজি, পরিবেশ ইত্যাদি বিষয় মাথায় রাখতে হয়। হুট করে বা চাপিয়ে দেয়া সিদ্ধান্ত ভালো ফল বয়ে আনে না; তাই রিকশা উঠিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যদি কিছু চিন্তা করতো তাহলে বোধহয় সবার জন্যই ভালো হতো।
চিন্তাগুলো কী? সেগুলো খুব বেশি জটিল নয়। যেমন, যে যানজটের দোহাই দিয়ে মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রিকশা উঠিয়ে দেওয়ার কথা বললেন, সেই যানজট কি তিনি রিকশামুক্ত এলাকায় দূর করতে পেরেছেন? সকালে পুরোপুরি রিকশামুক্ত মিরপুর রোডে কেন যানজটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকতে হয়? বেলা বাড়ার সাথে সাথে শাহবাগ থেকে ফার্মগেট এলাকা পার হতে কেন ঘণ্টাখানেকের বেশি লাগে? রিকশা দূর করে এসব এলাকা কি যানজটমুক্ত করা গেছে?
যানজটের জন্য একপাক্ষিকভাবে রিকশাকে দায়ী করা পুরনো বিলাসিতা। ভঙ্গুর গণপরিবহনকে না ঠিক করে, ধারণক্ষমতার বেশি ব্যক্তিগত গাড়ি নামানোর ব্যবস্থা করে, সিগন্যালিং সিস্টেমকে উন্নত ও পরিকল্পিত না করে, যান্ত্রিক বাহনের চালকদের যত্রতত্র পার্কিং ও লেন বদলানোর অভ্যাস না পাল্টিয়ে শুধু রিকশা নিষিদ্ধ করেই ঢাকাকে যানজটমুক্ত করা যাবে? আজকে ঢাকার যানজটের পেছনে যতোটা না রিকশা দায়ী, তার চেয়ে ব্যক্তিগত বাহনই যে বেশি দায়ী, তা এক পলকে ঢাকার সড়কগুলোতে চোখ বুলালেই বুঝা যায়। জ্বালানি তেল সাশ্রয় ও পরিবেশ দূষণরোধের দোহাই দিয়ে শুধু গণপরিবহনের বদলে ব্যক্তিগত বাহনের জ্বালানি হিসেবে সিএনজি ব্যবহারের যে অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল, সেই ভুলের খেসারতও দিতে হচ্ছে ঢাকাবাসীকে।
ঢাকার রাস্তাকে কীভাবে যানজটমুক্ত করা যায়, তা নিয়ে মেগাবাইটের পর মেগাবাইট ডিস্ক স্পেস খরচ হয়েছে। উপায় সবারই জানা। এই উপায়সমূহের একটিমাত্র অংশ হলো ব্যস্ত সড়ক থেকে রিকশা দূর করা। সাধারণ এই কাজটি করতে গিয়ে প্রতিবারই যে হাঙ্গামা হয়, তাতে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নকারীদের কর্মদক্ষতা ও বিবেচনাবোধের ওপরও প্রশ্ন তোলা যায়। অপরিকল্পিতভাবে শহরে রিকশা চালাতে দেওয়ার দোষে কর্তৃপক্ষের শাস্তি হয় না কেন? লাইসেন্সের চেয়ে বেশি রিকশা কোন জোরে চলে, সেই প্রশ্নের মীমাংসা হয় না কেন? রিকশাচালকদের বিকল্প কর্মসংস্থানের চিন্তা না হয় আধা-পুঁজিবাদী সরকারের কর্মকাণ্ডের আওতায় আসে না; কিন্তু মধ্যবিত্তের স্বল্পদূরত্বের যাতায়াতের কথা তো সরকারের ভোটব্যাংকের কারণেই চিন্তা করার কথা! রিকশা উচ্ছেদ করে সেই সড়কে কি পর্যাপ্ত বাস কিংবা অন্য যান্ত্রিক বাহন-সুবিধা নিশ্চিত করা গেছে? যাত্রীদের সুবিধাজনক স্থানে সিএনজি-ট্যাক্সি যেতে বাধ্য থাকবে, সেই ব্যবস্থা করা গেছে?
না। কোনো বিকল্প ব্যবস্থা না করে রিকশা উচ্ছেদ সম্ভব শুধু সেই সরকারেরই কাছে, যে সরকার গণবিচ্ছিন্ন হতে চায়। আগেও বলেছি, ঢাকার ব্যস্ত রাস্তায় রিকশা সমর্থনযোগ্য নয়; কিন্তু যে পদ্ধতিতে প্রতিবার রিকশা উচ্ছেদ করা হয়, তাও সমর্থনযোগ্য নয়। তার চেয়েও বড় কথা, রিকশা-উচ্ছেদের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে কোনো সরকারই ভাবে না। যতোদিন এগুলো নিয়ে না ভাবা হবে, ততোদিন পুরো ঢাকার সীমানা থেকে রিকশা দূর করে দেওয়া হলেও যানজট যে চুল পরিমাণ কমবে না, সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ থাকা যায়। তখন বরং অসুবিধা হবে সরকারেরই। এখন যাও ‘যতো দোষ রিকশা ঘোষ’ দেওয়া যায়, তখন সেটিও বলা যাবে না।
পুনশ্চ: ভাঙচুর-সংস্কৃতি আমাদের জাতীয় অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। কিছু হলেই শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে ভাঙচুর করে। হাসপাতালে গণ্ডগোল হলে রোগী কিংবা হাসপাতালের কর্মীরা রাস্তায় নেমে যায়। গার্মেন্টসে কিছু হলেও ভরসা সেই রাস্তা ও ভাঙচুর। রিকশাওলারা ব্যতিক্রম হবে কেন? নিজেদেরকে মূল স্রোতে রাখতে প্রতিবাদে তারাও যথেচ্ছ ভাঙচুর করেছে। অর্থাৎ আমরা যে যখন পারছি, সমানে ভেঙে চলছি। নিজেদের কু-মানসিকতা না ভেঙে অন্যের সম্পদ ধ্বংস করার মানসিকতা যেহারে বাড়ছে আমাদের চেতনার ভেতর, সেটি অ্যালার্মিং। অবশ্য সমস্যার মূল যেখানে খুঁজে বের করা হয় না, সেখানে প্রতিবাদের শেষ হাতিয়ার হিসেবে ভাঙচুর-ই বোধহয় উপায়ন্তরহীন হয়ে দাড়ায়। তবুও নাগরিক সুশীল হিসেবে সব ভাঙচুরের প্রতিবাদ জানাই।
Leave a Reply