শাহাদুজ্জামানের সঙ্গে আমার পরিচয় তাঁর বিসর্গতে দুঃখ বইয়ের মাধ্যমে, ২০০৫ সালে। ২০০৬ বা ২০০৭ সালে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জেমস পি. গ্র্যান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথের এক অনুষ্ঠানের পর ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় বা আইসিডিডিআরবি,র ছাদে চা খেতে খেতে তাঁকে আমার ওই বইয়ের প্রতি মুগ্ধতা জানাই। তিনি পরিমিত ও স্মিত হেসেছিলেন, ওটাও আমার ভালো লেগেছিলো। তখন আমাদের উভয়ের শরীরেই ঝরে পড়ছিলো রোদ, অনেকটা ডাকঘরের হলুদ খামের মতো রঙের।
মাঝখানে তাঁর আরও অনেক লেখা পড়েছি। মুগ্ধতা বেড়েছে। ফলে তাঁর সাম্প্রতিকতম গল্পের বই মামলার সাক্ষী ময়না পাখি পড়া শুরু করেছি মুগ্ধতা নিয়েই। পড়ার ইচ্ছে আগেই ছিলো, কিন্তু প্রথম আলোয় তিনি যখন দাবি করেন, “এত দিন গল্পের বিষয় ও আঙ্গিকের যে নিরীক্ষা আমি করে এসেছি, এই বইয়ে তার একটা সম্প্রসারণ হয়তো দেখা যাবে”, তখন দ্রুত বইটি পড়া শুরু করি। বইটি সম্পর্কে একবাক্য বলতে হলে আমার মন্তব্য— তাঁর দাবি যথাযথ এবং তিনি আমার মুগ্ধতা ‘আরও অনেকটাই’ বাড়িয়েছেন।
বইটিতে মোট ১১টি গল্প রয়েছে। ভূমিকায় লেখক জানিয়েছেন, ২০১৫ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে গল্পগুলো লেখা, অর্থাৎ তাঁর সাম্প্রতিক কাজের হদিশ মেলে তাতে।
বইয়ের প্রথম গল্পের নাম ‘জনৈক স্তন্যপায় প্রাণী, যিনি গল্প লেখেন’। মতিন কায়সার গল্প লেখেন, কিন্তু গল্প সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারেন না; কারণ তিনি সংশয়ে থাকেন, তার লেখা গল্প সত্যিই গল্প হয়ে ওঠে কিনা! এই গল্পটি এবং বইয়ের নামকরণ যে গল্পের নামে, এই দুটো গল্পই আমাকে বেশি টেনেছে। আমি এটিতে মুগ্ধ হয়েছি চারটি কারণে।
এক. মতিন কায়সারের এই সংশয়ের ভিত্তিটুকু দেখে। শুধু গল্পই নয়, পারিপার্শ্বিক অবস্থান থেকেও তিনি গল্প ও জীবন-গল্প সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারেন না। ফলে তিনি বাস্তবতা ও গল্পকে গুলিয়ে ফেলেননি, বুঝতে চেষ্টা করেন কোনটি আসলে গল্প হয়ে ওঠে।
দুই. গল্পের যেভাবে পরিসমাপ্তি টেনেছেন শাহাদুজ্জামান, তাতে গল্পের ভেতর গল্পের প্রবল অস্তিত্ব প্রকাশিত হয়েছে এবং উভয় গল্পই একটানে সমরেখায় এগিয়ে চলেছে।
তিন. কেন যেন মনে হয়েছে, শেষের কবিতায় রবীন্দ্রনাথ যেভাবে দীর্ঘদিন ধরে লেখালেখিতে থাকায় নিজেকে ব্যাঙ্গের মাধ্যমে একই বিষয় পুনঃপুন উৎপাদনের বিষয়টি নিয়ে তৎকালীন সাহিত্যিকদের একহাত নিয়েছিলেন, তারই একটি আধুনিক সংস্করণ এই গল্পে উপস্থিত।
চার. রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক ও সাহিত্যিক সৈকত আরেফিন জানেন, আমিও মাঝেমধ্যে টুকটাক গল্প ও কবিতা লেখার চেষ্টা করি, কিন্তু কখনওই নিশ্চিত হতে পারি না যে, সেগুলো আদৌ গল্প বা কবিতা হয়ে ওঠেছে কিনা। যেহেতু গল্প কী বা কবিতা কী—এসব বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান নেই, তাই এই সংশয় দিন দিন প্রবলতর হয়ে ওঠে। ফলে, লিখি, লেখার পর দীর্ঘদিন ফেলে রাখি, একসময় পুনরায় পাঠ করতে গিয়ে বিরক্ত হয়ে মুছে দিই। এ-কারণ শাহাদুজ্জামানের এই বইয়ের প্রথম গল্পটি পড়তে পড়তে মনে হয়েছে, গল্প লেখার যে সংশয় মতিন কায়সারের মধ্যে কাজ করে, তার কিছুটা আভাস ও অভ্যাস হয়তো আমার মধ্যেও আছে।
‘মৃত্যু সম্পর্কে আমার অবস্থান খুব পরিষ্কার’ গল্পটি ব্যতিক্রম। সক্রাতিসের মতো প্রশ্ন করতে করতে গল্পটাকে এগিয়ে নেওয়ার ধরনটা মুগ্ধ করেছে, কারণ এভাবেই ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করা হয়, “মেডিকেল সায়েন্স জীবন-মৃত্যুর কোনো সমাধান দিতে পারছে না কিন্তু আমাদের একটা নৈতিক দ্বিধার ভিতর ফেলে দিচ্ছে, তাই না কি?” প্রশ্নের আসা-যাওয়া মাঝখানে যে বিরক্তির উদ্রেক করেনি যে তা নয়, আমি ডাক্তার হলে হয়তো মারাত্মক বিরক্তই হতাম, কিন্তু যখন এই বাক্যটিতে পৌঁছালাম তখন মনে হয়েছে, এখানে পৌঁছার জন্য পূর্বের বিরক্তটুকু যথাযথ ছিলো।
তৃতীয় গল্পের নাম ‘টুকরো রোদের মতো খাম’। গল্পটিকে অসাধারণ বললেও হয়তো কম বলা হয়, শুধু একটা খটকা ছাড়া। আন্দালীবের আত্মীয় রাজীব তাকে যেভাবে বেওয়ারিশ চিঠিগুলো ডাকঘর থেকে দিয়ে দেয়, সেটা বাস্তবে আদৌ সম্ভব কি না? গল্পে হয়তো বাস্তব আনার প্রয়োজন পড়ে না, কিন্তু বাস্তব যখন বেশি-বাস্তব থাকে, তখন এমন খটকা গল্পকে দুর্বল করে দিতে পারে।
‘চিন্তাশীল প্রবীণ বানর’-এর কাহিনী পড়ে হতাশ হয়েছি, মুগ্ধ হয়েছি লেখা ও উপস্থাপনার ধরনে। গল্প যতোই এগিয়েছে, ট্যুইস্ট ধরতে কোনো সমস্যা হয়নি; যেহেতু মাথার ভেতর ঢাকাইয়া স্ল্যাংটা ঢুকে গিয়েছিলো। আর, এই মুহূর্তে মনে না পড়লেও, এ-ধরনের বা কাছাকাছি-ধরনের ট্যুইস্ট আগেও পড়েছি। থেকে থেকে মনেই হচ্ছিলো, এমনটাই ঘটবে, আর এভাবেই শেষ হবে গল্পের। এই গল্প আমাকে টানেনি, টেনেছে গল্পের ধরন।
এতোদিন তিনি যে নিরীক্ষা করেছেন গল্পে, তার ছাপ আছে। তবে সেই ছাপ কাহিনীতে যতোটুকু, গল্প লেখা ও গল্পের উপস্থাপনায় তার চেয়ে বেশি। তাঁর কাহিনী যতোটুকু টেনেছে, তার চেয়ে বেশি টেনেছে কাহিনীর উপস্থাপন।
‘পৃথিবীতে হয়তো বৃহস্পতিবার’ গল্পটি অনেক চাকুরিজীবির জন্য প্রযোজ্য হতে পারে, বিশেষ করে যাদের চিন্তা বা আইডিয়া অন্যে মেরে খেয়েছে, তাদের জন্য। এই গল্পটি নিয়ে কোনো মন্তব্য করা মুশকিল, কারণ মাসুদের অনুভূতি উপলব্ধি করতে পারলেও সমাপ্তিটা একেবারেই বুঝতে পারিনি।
পুরো বইয়ের সবচাইতে দুর্বল গল্প, আমার মতে, আদতে এই লেখায় যা যা বলছি সবই পাঠক হিসেবে আমার মত, ‘উবার’। পাঠককে টান টান উত্তেজনার মধ্যে রেখেছেন সত্যি, কিন্তু এই গল্প শাহাদুজ্জামান-মানের হয়নি। এবং একই মন্তব্য প্রযোজ্য ‘অপস্রিয়মান তির’ গল্পের ক্ষেত্রে। তবে, যাদের শিশু ও কিশোরবয়সী সন্তান আছেন, তারা সচেতনতার নিমিত্তে গল্পটি পড়তে পারেন।
‘ওয়ানওয়ে টিকিট’ গল্পটা পূর্বের দুটো গল্পের চেয়ে ভালো, কিন্তু নতুনত্ব সেখানে নেই। আদতে, প্রথম বা মলাটনামের গল্পের যে জমাট বুননশৈলী তৈরি করেছেন শাহাদুজ্জামান, সেই তুলনায় এগুলো সাধারণ মানের। কী ঘটবে আন্দাজ করা অসুবিধা যেমন হয় না, তেমনি কাহিনীতেও বলার মতো কিছু নেই আসলে।
‘লবঙ্গের বঙ্গ ফেলে’ গল্পটির সমাপ্তিও যারপরনাই হতাশ করেছে, কারণ একটু সচেতন পাঠক বিশেষ করে যারা ট্যুইস্ট ধরতে আগ্রহী, তাদের জন্য এই একেবারেই সহজ এক গল্প; কেবল তা উৎরে গেছে শাহাদুজ্জামানের শক্তিশালী লেখার কারণে। যেভাবে নার্গিস পারভীনের চিত্রায়নের শুরু, সেটি অসাধারণ; যেভাবে সমাপ্তি, সেটি সাধারণ।
আবদুল করিম খানের একটি পুঁথি অবলম্বনে তিনি বইয়ের যে নাম দিয়েছেন, মামলার সাক্ষী ময়না পাখি, সেটি এই বইয়ের একটি গল্প থেকেই নেওয়া। গল্পের উপস্থাপনা দারুণ, রয়েছে সমসাময়িক ঘটনার সূত্রও। কিন্তু আগের কিছু গল্পের মতোই শাহাদুজ্জামান এখানে যেভাবে সমাপ্তি টেনেছেন, সেটি সাধারণই রয়ে গেছে। এতো সহজে তিনি বজলুকে নিষ্কৃতি দিলেন, সেটি বোধহয় আজকের দিনে সম্ভব নয়, বিশেষত সাংবাদিকদের কাছে। বলা যায়, গল্পটির সমাপ্তির প্রতি অবিচারই করেছেন তিনি।
শেষ গল্প, অর্থাৎ ‘নাজুক মানুষের সংলাপ’ কেন গল্প, তা আমি বুঝতে পারিনি। ফলে এ-নিয়ে কোনো মন্তব্য নেই। শুধু প্রশ্ন জেগেছে, কেন একে গল্প বলবো?
সব মিলিয়ে তাহলে আমার মন্তব্য কী?
প্রথমত, শাহাদুজ্জামানের প্রতি আমার যে চাহিদা, তা মোটাদাগে তিনি মিটিয়েছেন।
দ্বিতীয়ত, গল্প-সমাপ্তিতে শাহাদুজ্জামানকে ঠিক বুঝতে পারছি না। কখনও তিনি দুর্দান্তভাবে শেষ করেছেন, কখনও নেমে গেছেন নিজের মানের চেয়েও নিচে। এবং ঘটনাটি ঘটেছে একই বইতে।
তৃতীয়ত, এতোদিন তিনি যে নিরীক্ষা করেছেন গল্পে, তার ছাপ আছে। তবে সেই ছাপ কাহিনীতে যতোটুকু, গল্প লেখা ও গল্পের উপস্থাপনায় তার চেয়ে বেশি। তাঁর কাহিনী যতোটুকু টেনেছে, তার চেয়ে বেশি টেনেছে কাহিনীর উপস্থাপন।
চতুর্থত, অন্তত দুটো গল্প এই বইয়ের মানে হয়নি।
পঞ্চমত, বইটির কিছু কিছু গল্প নিয়ে শাহাদুজ্জামান প্রথম আলোতে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। মনে হয়েছে, সাক্ষাৎকারে তিনি যা বলেছেন, বইতে তার প্রতিফলন তুলনামূলকভাবে কম।
মামলার সাক্ষী ময়না পাখি বইটির প্রচ্ছদ করেছেন সব্যসাচী হাজরা। আগেকার দিনের পুঁথির মতো করে প্রচ্ছদ করা হয়েছে। অসাধারণ!
যদিও এই লেখায় অনেক কথাই বলেছি, কিন্তু শেষ বাক্য হিসেবে এটিও বলা প্রয়োজন, যে-ধরনের গল্প সচরাচর আমি পড়ি, শাহাদুজ্জামান সেখানে নিজেকে ব্যতিক্রম হিসেবেই দেখিয়েছেন, আবারও।
বইয়ের তথ্য
বইয়ের নাম: মামলার সাক্ষী ময়না পাখি
লেখক: শাহাদুজ্জামান
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০১৯
প্রচ্ছদ: সব্যসাচী হাজরা
পৃষ্ঠা: ১১২
দাম: ২৪০ টাকা
Leave a Reply