বেশ কিছুদিন আগে পর্যটন বিষয়ক একটি লেখা প্রকাশের পর পরিচিত একজন বাংলাদেশের বাইরে পর্যটনের অভিজ্ঞতা আছে কিনা জানতে চেয়েছিলেন। ‘খুব সামান্য’ জবাব দেয়ায় তিনি উপদেশ দিয়েছিলেন- সম্ভব হলে অন্তত পাশের কয়েকটি দেশ যেমন ভারত, ভুটান এবং নেপাল ঘুরে এসে তারপর যেন বাংলাদেশের পর্যটন নিয়ে আশাবাদী হই। গুরুতর কিছু না হলে সাধারণত পাঠক প্রতিক্রিয়াকে সম্মান জানিয়ে একমত হওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু তার বক্তব্যে এমন কিছু দৃঢ়তা ছিল যে কারণে পরবর্তী সময়ে বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হয়েছে। নানা দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যটন বিষয়ে তার সঙ্গে কিছু আলোচনাও হয়েছে। তার কথায় মনে হয়েছে, বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প নিয়ে আমি যে আশাবাদ ও উচ্ছ্বাস ব্যক্ত করেছি বা করছি, কিছু দেশ ঘুরলে আমার সেই বক্তব্য বদলেও যেতে পারে।
সম্প্রতি ব্যক্তিগত কাজে প্রায় ১৫ দিন ভারত ভ্রমণের সুযোগ হয়েছিল এবং প্রথম দিন থেকেই ওই পরিচিতজনের কথাগুলো মনে করে বুঝার চেষ্টা করছিলাম ভারতের তুলনায় বাংলাদেশের পর্যটনের অবস্থান কোথায়? ভারত সম্পর্কে মিথ চালু আছে যে, পুরো ভারত ভ্রমণ করলে নাকি পৃথিবীর সব জায়গা দেখা হয়ে যায়। পর্যটকরা সাধারণত যেসব জায়গায় ঘুরতে যায় (যেমন- জলপ্রপাত, মরুভূমি, বনাঞ্চল, পাহাড়-পর্বত, সমুদ্র, তুষারপাত ইত্যাদি), তার সবকিছুই নাকি শুধু ভারত ঘুরেই দেখা সম্ভব এবং অন্য কোনো দেশেই এরকমটি পাওয়া যাবে না। ভারতের সব এলাকা সম্পর্কে জ্ঞান নেই, তাই এ ধরনের কথা অতিশয়োক্তি বলেই মনে হয়।
ভারত একটি বিশাল দেশ; তার তুলনায় আয়তনের দিক দিয়ে বাংলাদেশ পৃথিবীর খুব কম জায়গা দখল করে আছে। একটি দেশ বিশাল হলে সেখানে অধিক দর্শনীয় স্থান থাকাটাই স্বাভাবিক। পর্যটন বিষয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সেরকম তুলনামূলক আলোচনা সে অর্থে নিরর্থক। কিন্তু পর্যটক আকৃষ্ট করার জন্য কোন দেশ পর্যটন শিল্পকে কীভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে তা নিয়ে একটি তুলনামূলক আলোচনা হতে পারে। বছর দুয়েক আগের ত্রিপুরা ভ্রমণের স্মৃতি ও দিন কয়েক আগের কলকাতা ও দিল্লি ভ্রমণের টাটকা অভিজ্ঞতা থেকে সহজেই বলা যায়- বেশ কিছু ক্ষেত্রে সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের পর্যটন কর্পোরেশন যেখানে সর্বোচ্চ মাত্রার উদাসীনতা দেখাচ্ছে, সেখানে ভারত সরকার ছোটখাট পর্যটন কেন্দ্রকেও পর্যটকদের কাছে সাজিয়ে-গুছিয়ে-আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করছে। শুধু তাই নয়, পর্যটনকে সফলকাম করতে শুধু দর্শনীয় বস্তুই বিবেচ্য বিষয় হয় না; পর্যটকদের থাকার জায়গা, যাতায়াত, নিরাপত্তা ব্যবস্থা ইত্যাদি বিষয়কে সামগ্রিকভাবে পর্যটকদের কাছে সুলভ হিসেবে উপস্থাপন করতে হয়। বলা যায়, Incredible India শিরোনাম দিয়ে ভারত সে কাজটি যথাযথভাবে করে চলেছে।
কিছু উদাহরণও দেয়া যেতে পারে। ভারতের বড় শহরগুলোতে নানা প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা পর্যটকদের জন্য দিনব্যাপী ভ্রমণের ব্যবস্থা করে থাকে। এসব প্রতিষ্ঠান প্যাকেজ ট্যুরের মাধ্যমে পর্যটকদের সারাদিন শহরের নানা দর্শনীয় স্থান ঘুরিয়ে নিয়ে আসে। ঢাকাতেও একসময় এ ব্যবস্থা ছিল, পর্যটকদের জন্য ছাদ খোলা গাড়ি দেখা যেত ঢাকার রাস্তায়, কিন্তু খুব দ্রুতই সেগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। যানজট বা অন্যান্য কারণে রাজধানীতে এখন এ ব্যবস্থা চালু করা সম্ভব কি? ভারতে রেলভ্রমণে বিদেশিদের জন্য আলাদা কোটা আছে, আলাদা ব্যবস্থা আছে সিনিয়র সিটিজেনদের জন্যও। আমাদের কি এমন কিছু আছে? কোথাও গেলে স্বল্পমূল্যে পর্যাপ্ত গাইডের সন্ধান মেলে। আমাদের গাইড তো নেই-ই; বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রে নোটিশবোর্ডের তথ্য পড়তে হয় অনেক কষ্ট করে। বাইরের খাবারের দাম বেশি হলেও ভেতরের রেষ্টুরেন্টে খাবারের দাম থাকে তুলনামূলকভাবে কম, আমাদের দেশে যা উল্টো। প্রতিটি পর্যটন স্পটে প্রয়োজনীয় সংখ্যক বুকলেট, সিডি বা ম্যাপ পাওয়া যায় যাতে পর্যটক সহজেই সে এলাকা সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে পারে। রেলস্টেশন, মেট্রো বা হাইওয়েতে বিস্তারিত নির্দেশনা দেয়া থাকে, মেট্রো রেলে স্থানীয় ভাষার পাশাপাশি ইংরেজিতে বর্ণনা দেয়া হয়। এ সবকিছুই পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্য। শুনতে খারাপ লাগতে পারে কিন্তু নির্মোহভাবে বিচার করলে বাংলাদেশ এই দিকগুলোতে এখনো অনেক পিছিয়ে।
অপরদিকে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভারত মোটেই পর্যটনবান্ধব নয়, বরং বাংলাদেশ এসব বিষয়ে অনেক ভালো। পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে প্রবেশের ক্ষেত্রে ভারতীয়দের জন্য যে পরিমাণ চার্জ, বিদেশি পর্যটকদের জন্য প্রবেশমূল্য তার চেয়ে বহুগুণ বেশি। তাজমহলে প্রবেশে ভারতীয়দের জন্য চার্জ মাত্র ২০ রুটি, সেখানে বিদেশিদের ক্ষেত্রে এই চার্জ ৭৫০ রুপি। শুনেছি অজন্তা ইলোরা গুহায় প্রবেশ করতে হলে ভারতীয়দের ১০ রুপি এবং বিদেশিদের একশ গুণ বেশি অর্থাৎ ১০০০ রুপি দিয়ে টিকিট কাটতে হয়। ৭৫০ বা ১০০০ রুপিকে ডলারে হিসেব করলে হয়তো খুব বেশি মনে হবে না, কিন্তু একটি দেশকে পর্যটনসুলভ করতে হলে প্রতিবেশি দেশগুলোর অর্থনৈতিক কাঠামোও বিবেচনায় নিতে হয়। অনেক দেশই অভ্যন্তরীণ পর্যটন উৎসাহিত করতে দেশীয় পর্যটকদের জন্য দাম কম রাখে। কিন্তু যেখানে বিপুল সংখ্যক পর্যটক আসে পাশের একই অর্থনৈতিক সক্ষমতার দেশ যেমন বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল বা শ্রীলংকা থেকে, সেখানে তাদের সাথে আমেরিকা বা ইউরোপের পর্যটকদের এক কাতারে ফেলা মোটেও বুদ্ধিমানের কাজ নয়। ভারত কি পারতো না সার্ক দেশগুলোর জন্য গ্রহণযোগ্য মাত্রার প্রবেশমূল্য নির্ধারণ করতে? তাজমহল ভ্রমণের সময় সার্ক দেশগুলোর অনেক পর্যটককে দেখেছি ভারতীয় পরিচয়ে টিকিট কাটতে কারণ এদেরকে চেহারা বা গায়ের রং দিয়ে আলাদাভাবে বিদেশি হিসেবে চিহ্ণিত করা যাবে না। পর্যটক বললেই যেরকম চোখের সামনে ধনী মানুষরে ছবি ভেসে উঠে যার প্রচুর টাকাপয়সা আছে, বিষয়টি অনেক সময় সেরকম না-ও হতে পারে। অনেক পর্যটকই দিনের পর দিন অর্থ সঞ্চয় করে কেবল বেড়ানোর নেশায় কম খেয়ে, সস্তা হোটেলে থেকে দেশে-বিদেশে ঘুরে বেড়ান এবং এরকম পর্যটক নেহায়েত কম নয়। গ্রহণযোগ্য মাত্রার প্রবেশমূল্য থাকলে এ ধরনের পর্যটকদের যেমন নিজস্ব সত্ত্বা লুকিয়ে টিকিট কাটতে হয় না, তেমনি আরো বেশি সংখ্যক পর্যটককেও আকৃষ্ট করা সম্ভব। এ দিক দিয়ে বাংলাদেশ বরং পর্যটকবান্ধব। কিছু নির্দিষ্ট জায়গা ছাড়া অন্যান্য জায়গায় বিদেশি পর্যটকদের কাছ থেকে অনেক উঁচু হারে প্রবেশমূল্য নেওয়ার ব্যবস্থা নেই এখানে। যেখানে প্রবেশমূল্য বেশি সেখানেও তা গ্রহণযোগ্য মাত্রার মধ্যেই রয়েছে।
আতিথেয়তার দিক দিয়েও বাংলাদেশের সুনাম রয়েছে। দিল্লিতে চলতে-ফিরতে অনেক সময়ই মনে হয়েছে সেখানকার মানুষজন বিশেষ করে বাংলাভাষীদের ওপর বিরক্ত। স্থানীয় কয়েকজন বাঙালির সাথে কথা বলে সেরকম ধারণাই পাওয়া গেল। যদিও ভারতের নানা সরকারি প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা যেমন- রেলওয়ে, পর্যটন কর্পোরেশনের মোটেল ইত্যাদি পর্যটকদের গুরুত্ব দিয়ে থাকে, কিন্তু সাধারণ মানুষের ব্যবহার ও তাদের ক্ষণিকের আতিথেয়তাও একসময় বিচার্য বিষয় হয়ে ওঠে। দিল্লিতে বসবাসকারী বেশ কিছু বাঙালির কাছ থেকে শুনেছি, এখানকার অনেক মানুষই বাংলাদেশীদের সম্পর্কে বিরূপ মনোভাব পোষণ করে থাকে। বাংলাদেশের একটি ট্রাভেল এজেন্সির মালিক বারবার সাবধান করে দিয়েছিলেন, দিল্লিতে কোনো সমস্যায় পড়লে অন্য কারো কাছে না গিয়ে সরাসরি যেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছেই যাই। কারণ, তার মতে, ওখানে ঠগ-জোচ্চোরে ভর্তি। সাহায্য চাইতে গিয়ে ভালো মানুষের বদলে এদের পাল্লায় পড়লে সর্বস্বান্ত হওয়াটা নিশ্চিন্ত। ট্রাভেল এজেন্সির মালিকের কথা আমরা উড়িয়েই দিয়েছিলাম। কিন্তু কলকাতা থেকে রেলপথে দূরন্ত এক্সপ্রেসে নয়া দিল্লি যাওয়ার সময় ওখানকার সহযাত্রীদেরকে বাংলাদেশ থেকে নিয়ে যাওয়া বিস্কুট খাওয়ানোর পর তারা আমাদের একটাই উপদেশ দিলেন- আমরা যেন ভুলেও রেল বা অন্য কোনো জায়গায় অন্য কারো দেয়া কিছু না খাই। একে আমরা বাংলাদেশ থেকে এসেছি, তার ওপর তাদের কাছে আমাদেরকে খারাপ ব্যক্তি বলে মনে হয় নি, সে কারণে তারা আমাদের দেয়া বিস্কুট খেয়েছেন। বিস্কুট বা খাবার খাইয়ে সর্বস্বান্ত করার ঘটনা আমাদের দেশেও ঘটে, কিন্তু ওখানকার যে ভয়াবহ অবস্থার কথা শুনেছি, সেটা আমাদের দেশের স্বাভাবিক চিত্র নয়। একটি শহরের অভিজ্ঞতা দিয়ে সেই দেশের মূল্যায়ন করা কাজের কথা নয়, কিন্তু আতিথেয়তার যে উদাহরণ উপরে দেয়া হলো, বাংলাদেশের অবস্থান তার বিপরীত। এখানে বিদেশ থেকে কেউ এলে আমরা বরং আতিথেয়তার পরিমাণ বাড়িয়ে দিই। অতিথিকে নারায়ণ সমতুল্য মনে করে তাকে সেবা করার রীতিটি এ দেশে ভালোভাবেই প্রচলিত। বিশেষ কোনো দেশ থেকে আসা মানুষকে কটাক্ষের চোখে দেখা আমাদের সংস্কৃতি নয়।
ভারত অনেক বড় দেশ, অনেক পর্যটন স্পট রয়েছে সেখানে। আয়তনে বাংলাদেশ ছোট, পর্যটন স্পটও তুলনামূলকভাবে কম। সে দিক দিয়ে বিচার করলে বাইরের একজন পর্যটকের কাছে বাংলাদেশের চেয়ে ভারতকেই আকর্ষণীয় মনে হওয়ার কথা; কিন্তু আমরা যদি আমাদের আতিথেয়তার কথা, সীমিত পর্যটক স্পটে অপরিসীম উষ্ণতার কথা বিদেশি পর্যটকদের জানাই, তাহলে তো আমাদের পর্যটন শিল্প ফুলেফেঁপে উঠার কথা! কিছু প্রয়োজনীয় সুযোগসুবিধা বাড়ালে অভ্যন্তরীণ পর্যটন দিয়েই পর্যটন কর্পোরেশন নিজেদেরকে বিকশিত করতে পারে। শহরের পাঁচতারা হোটেলের রাজকীয় সুযোগ-সুবিধার চেয়ে মানুষ এখনো নানা অসুবিধার কথা মনে রেখেও আত্মীয়ের বাড়ির উষ্ণ অভ্যর্থনাকেই পছন্দ করে। পর্যটনকে বিকশিত করতে হলে পর্যটন কর্পোরেশন এই মূলমন্ত্রকে ভিত্তি ধরেই সামনে এগোতে পারে।
Leave a Reply