ঈদ কিংবা লম্বা ছুটিতে শহরের মানুষ পরিবারের সবার সঙ্গে ছুটি উপভোগ করতে গ্রামের বাড়িতে যায়। নগরজীবনের এটা স্বাভাবিক চিত্র হলেও সাম্প্রতিককালে এর ধরন অনেকটাই পাল্টেছে। অনেকে এখন লম্বা ছুটি গ্রামে না কাটিয়ে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে অন্য কোথাও বেড়াতে যান। গত তিন-চার বছর ধরে ঈদের ছুটির সময়ে কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি বা বান্দরবানের হোটেল, মোটেল ও রিসোর্টগুলো পরিপূর্ণ বলে পত্রিকাগুলোতে খবর বেরুচ্ছে। এমনও শোনা গেছে, হোটেলে জায়গা না পেয়ে অনেককে গাড়িতেই রাত কাটাতে হয়েছে। বেড়ানোর এই চিত্র কিন্তু কিছুকাল আগেও ভাবা যেত না। ঘরকুনো বলে যে বদনাম আছে, নাগরিক মধ্যবিত্তরা বোধহয় সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। আর কিছু না হোক, বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের জন্য এটা বেশ আশাপ্রদ।
পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য পড়ে মনে হয়, ওখানকার মানুষজন ছুটি পেলেই কোথাও না কোথাও বেরিয়ে পড়ে। সুনীল-শীর্ষেন্দু-বুদ্ধদেবের প্রচুর পাঠক আছেন এদেশে। সেই সাহিত্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে বা ফিবছর বাড়ি যাবার বিড়ম্বনা এড়াতে কিংবা মানসিকতার পরিবর্তন- যে কারণেই হোক, মানুষের এই বেড়ানোর অভ্যাসটি ইতিবাচকভাবে দেখা দরকার। আমরা নানা সময় নিজের দেশকে অপরূপ হিসেবে উপস্থাপন করি, বিশেষত আবেগের জায়গা থেকে প্রায়ই বলে থাকি- এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি! কিন্তু দেশটিকে দেখার ক্ষেত্রে আমাদের একটা জন্মগত অবহেলা ছিল সবসময়। যদিও এ অবহেলার পেছনে খোদ পর্যটনের প্রতি মানুষের অনীহা নাকি নানা অসুবিধার কারণে মানুষ বেড়াতে অনাগ্রহী- সেটি অন্য বিতর্কের বিষয়।
অভ্যন্তরীণ পর্যটনের লক্ষ্যগোষ্ঠী কারা? অবশ্যই মধ্যবিত্তরা। উচ্চবিত্তরা দেশের ভিতরে বেড়াতে ভালোবাসে না- ছুটিছাটা পেলে চলে যায় বিদেশের কোনো পর্যটন স্পটে। নিম্নবিত্তদের সামর্থ্য কম; ঈদ কিংবা পূজায় তারা বড়জোড় নিজ এলাকার মেলা বা শিশুপার্কজাতীয় স্থানে বেড়াতে যায়। একমাত্র মধ্যবিত্তরাই নিজ গণ্ডীর বাইরে অন্য এলাকায় যেতে পছন্দ করে এবং তাদের সে সামর্থ্যও আছে। তাছাড়া দেশের নানা জায়গায় ছোট-বড় অনেক পর্যটন স্পট থাকলেও অনেকেই সেগুলোর খবর জানতো না। মিডিয়ার কল্যাণে এখন সেগুলো উঠে আসছে। পর্যটন স্পট নির্বাচন করার ক্ষেত্রেও প্রচলিত চিন্তাচেতনা থেকে মানুষ একটু একটু করে বেরিয়ে আসছে। আগে কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ইত্যাদি নামকরা জায়গার প্রতি মানুষের আগ্রহ ছিল। কিন্তু অনেকেই এখন স্বল্পপরিচিত বা অপরিচিত সুন্দর কোনো জায়গা, নদীর ধারে কাশফুলের মাঠ কিংবা স্রেফ গ্রাম দেখতেও বেরিয়ে পড়ে। এ ধরনের পর্যটক কম হলেও দিন দিন এদের সংখ্যা বাড়ছে। ঢাকা শহরের মানুষ আজকাল এমনকি মাওয়া ফেরিঘাটও দেখতে যায়, একদিনের ছুটি পেলে চলে যায় মানিকগঞ্জের পুরনো মসজিদ বা মন্দির দেখতে কিংবা ঘুরে আসে বঙ্গবন্ধু সেতু থেকে।
দেশে নানা সেক্টরে বেসরকারি খাতের বিকাশ ঘটেছে। বেড়েছে এনজিও, মিডিয়া কিংবা পাবলিক রিলেশনে কর্মরত মানুষের সংখ্যাও যাদের অফিসিয়াল কাজে বিভিন্ন জেলায় যেতে হয়। তারাও কিন্তু কাজের ফাঁকে দর্শনীয় জায়গাগুলো থেকে ঘুরে আসেন। অফিসিয়াল কাজে কেউ দিনাজপুর গেলে রামসাগর বা কান্তজীউর মন্দির থেকে ঘুরে আসেন; শ্রীমঙ্গল গেলে চা বাগান দেখে আসা বাধ্যতামূলক কাজের মধ্যেই পড়ে। ঢাকার বাইরে অফিসিয়াল কাজের পাশাপাশি বেড়ানোর বিষয়টি অনেকেই উপভোগ করেন। কাজের সুবাদে বরিশাল যেতে হলে অনেকে দিনের বেলা বাসে না গিয়ে ভ্রমণের জন্য রাতটাই বেছে নেন, কারণ তাতে লঞ্চে নদীপথ ভ্রমণ করতে করতে যাওয়া যায়। আর সেদিন পূর্ণিমা হলেও তো কথাই নেই!
শুধু কি তাই! আজকাল অনেকে একদিনের ভ্রমণেও উৎসাহী হচ্ছেন। আগে থেকে বুকিং না দেয়া থাকলে ঈদ কিংবা পূজার ছুটির দিন বা তার পর দিন ঢাকা শহরে রেন্ট-এ-কার থেকে গাড়ি বা মাইক্রোবাস ভাড়া পাওয়া যায় না। কারণ একদিনের ছুটিতে অনেকে ঢাকার বাইরের ঘুরতে বেরিয়ে পড়েন। ময়মনসিংহ, নরসিংদী, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ কিংবা মুন্সীগঞ্জের নানা লোকেশনে তখন শহরের মানুষদের ঘুরতে-ফিরতে দেখা যায়। চট্টগ্রামের মানুষরা চলে যান কক্সবাজার বা পার্বত্য এলাকায়। বড় ছুটি না থাকলেও সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্র বা শনিবারে অনেকে বেড়াতে বের হন। এ বিষয়ে যদিও হাতের কাছে কোনো পরিসংখ্যান নেই, কিন্তু হিসেব করলে এ ধরনের পর্যটকের সংখ্যা খুব কম হবে না।
কিন্তু পর্যটনে গিয়ে পর্যটকেরা কি সন্তুষ্ট? অধিকাংশ ক্ষেত্রেই উত্তর না-বোধক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অবকাঠামোগত অসুবিধা তো রয়েছেই, নিরাপত্তা নিয়েও পর্যটকরা উদ্বিগ্ন থাকেন। কক্সবাজারের মতো এলাকায় পর্যটকরা ছিনতাইসহ নানা রকমের নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। সমুদ্রতীরে চাঁদের আলোয় হেঁটে বেড়াতে কার না ভালো লাগবে! কিন্তু ছিনতাইকারী বা বখাটেদের উৎপাতে সেটি হবার জো নেই। বিশেষত নারী ও বিদেশি পর্যটকরা যে রাতে একটু নিরুদ্বিগ্নভাবে ঘুরে বেড়াবে, সেটি সব সময় সম্ভব হয় না। দিনের বেলায় ফেরিওয়ালাদের উৎপাত তো আছেই! তাছাড়া পর্যটন স্পটে জিনিসপত্রের যে অগ্নিমূল্য দেখা যায়, তাতেও পর্যটকেরা অনুৎসাহিত হন। একটি আধা-লিটার পানির সর্বোচ্চ খুচরা দাম যেখানে ১২ টাকা, পর্যটন স্পটে সেটি কেন ২৫ টাকা হবে? কেন পর্যটকদের কাছ থেকে কোরাল মাছের দাম নিয়ে অন্য সামুদ্রিক মাছ খেতে দেয়া হবে?
বাংলাদেশে পর্যটন শিল্প বিকাশের দারুণ সুযোগ রয়েছে। বিদেশিরা আসুক বা না আসুক, অভ্যন্তরীণ পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটাতে পারলেই এ শিল্পটি নিজ ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে যাবে। ১৫ কোটির বেশি মানুষের অন্তত ১০ ভাগও যদি প্রতিবছর দেশের কোথাও না কোথাও বেড়াতে যায়, তাহলে এর অর্থনৈতিক প্রভাব কতোটা বিশাল হবে সেই হিসেব অর্থনীতিবিদরা সহজেই বের করতে পারবেন। দেশের রাজস্ব খাতেও কম টাকা আয় হবে না। কিন্তু এই পর্যটন নিশ্চিত করার জন্য অন্তত তিনটি বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে- অবকাঠামো, নিরাপত্তা এবং জিনিসপত্রের মান ও দামের সামঞ্জস্য। প্রথমটি নিশ্চিত করার জন্য সরকারের চেয়ে বেসরকারি উদ্যোক্তারাই এগিয়ে আসতে পারে কিন্তু বাকিগুলোর ক্ষেত্রে মনিটরিঙের কাজটি সরকারকেই করতে হবে।
পর্যটন স্পট তৈরির ক্ষেত্রেও আমাদের প্রচলিত ভাবনার বাইরে আসা দরকার। এখন সমুদ্রসৈকত বলতে আমরা মূলত কক্সবাজার, কুয়াকাটা বা পতেঙ্গাকেই বুঝি, কিন্তু কয়জন খবর রাখি যে বরগুনার মতো এলাকায় ছোট ছোট কিছু চমৎকার সমুদ্রসৈকত রয়েছে? ময়মনসিংহে ব্রহ্মপুত্রের তীরে কেন বেশ কিছু ভালো ভালো রিসোর্ট গড়ে উঠবে না? কেন মানুষ চাইলেই দু-তিন রাতের জন্য হাওর ভ্রমণে যেতে পারবে না? কেন কুমিল্লা বা ফেনীর সীমান্ত এলাকাসংলগ্ন বনাঞ্চলে বেশ কিছু পর্যটন স্পট গড়ে উঠবে না? ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য কর্তৃপক্ষ তাদের সীমান্ত এলাকাগুলোতে বেশ কিছু রিসোর্ট বা মোটেল বানিয়ে রেখেছে পর্যটকের সুবিধার্থে। নগরজীবনের একঘেয়ে ক্লান্তি এড়াতে অনেকেই সেই রিসোর্টগুলোতে কয়েকটা দিন কাটিয়ে আসেন। বিদেশে অনেক নদীর তীরে ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রচুর রিসোর্টের সন্ধান মেলে। বাড়ির মালিকই হয়তো নদীর তীরে নিজস্ব জমিতে দু-তিনটি কটেজ বানিয়ে রেখেছে পর্যটকদের জন্য। এসব কটেজ খালি থাকে না বলেই শুনেছি। প্রতিদিনকার জীবনযাপনের বাইরে একটু বাড়তি ছন্দ কিংবা ভিন্নতাই যে পর্যটন, সেটি উপলব্ধি করতে পারলে আমরাও হয়তো একসময় এ ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে পারবো।
আগেকার সময়ের পর্যটনের সাথে এখনকার পর্যটনের ধারণার অনেক পার্থক্য রয়েছে। ইবনে বতুতা বা হিউয়েন সাঙ যে ধরনের পর্যটক ছিলেন, সে ধরনের পর্যটক এখন অনেক খুঁজে পাওয়া ভার। পরিবর্তিত সময় ও গতিশীল জীবনই হয়তো এর কারণ। আগে পর্যটকেরা একটা জায়গায় শুধু মুগ্ধ হওয়ার জন্য ভ্রমণ করতেন না, সেই এলাকার মানুষের জীবন, সংস্কৃতি কিংবা পরিবেশ অধ্যয়ন ও পর্যবেক্ষণ ছিল তাদের পর্যটনের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। এ সময়ের পর্যটকেরা কি সেদিকে নজর দেন? আজকাল বেড়াতে বের হওয়া মানে মুগ্ধ হতে যাওয়া। যে সুন্দরবনে বেড়াতে গিয়ে এর সৌন্দর্য দেখে আমরা মুগ্ধ হই, লঞ্চের পাশ দিয়ে বেয়ে চলা সুন্দরবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ জেলে-নৌকা দেখে তাদের অবস্থার কথা আমরা কয়জন ভাবি? আমরা কয়জন কোনো এলাকা থেকে ঘুরে এসে সেগুলো লিখে রাখি বা প্রকাশ করি? এখানে অবশ্য প্রকাশের ক্ষেত্রে নানা সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। বিখ্যাত ব্যক্তি ছাড়া প্রিন্ট মিডিয়াগুলো সাধারণ মানুষের ভ্রমণকাহিনী খুব কমই ছাপে বা ছাপেই না। অথচ মানুষের এ ধরনের লেখা বা অনুভূতি অন্যদের উদ্ধুদ্ধ করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।
বাংলাদেশের পর্যটন নিয়ে এ ধরনের নানা চিন্তাভাবনা করা যেতে পারে। প্রচলিত চিন্তাচেতনার বাইরে গিয়ে পর্যটনকে একটু দেশীয় ছোঁয়া দিতে পারলে অভ্যন্তরীণ পর্যটকের সংখ্যা বিপুলভাবে বেড়ে যাবে সন্দেহ নেই। বাংলাদেশের ভৌগোলিক পরিবেশ এমনই যে, একটু চেষ্টা করলে সারা দেশটাকেই পর্যটন স্পট হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। আমরা অনেকেই যেখানে জন্মেছি, তার পাশের উপজেলা বা জেলাতে যাই নি; কিন্তু একটা পর্যটন স্পট থাকলে সহজেই মানুষ আশেপাশের জেলাগুলোতে বেড়াতে যেতে পারতো। পর্যাপ্ত উদ্যোগ থাকলে জেলা পর্যটনও হতে পারে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের অন্যতম শক্তিশালী ক্ষেত্র। অনেক বেসরকারি ট্যুর অপারেটর এসব ক্ষেত্রে কাজ শুরু করলেও নানা মাত্রায় পর্যটন শিল্পের সার্বিক ভাবনা ও বিকাশে বাংলাদশ পর্যটন কর্পোরেশনকেই এগিয়ে আসতে হবে।
Leave a Reply