কৃষণ চন্দরের কথা সম্ভবত নতুন করে কিছু বলার নেই। অসাধারণ, এবং অসম্ভব অসাধারণ এই মানুষটির লেখা আমি বরাবরই মুগ্ধ হয়ে পড়ি। তেমন মুগ্ধতায় নতুন করে পুনরায় যুক্ত হলো ‘গাদ্দার’। গাদ্দার বইটি আগেও পড়া ছিল। কিন্তু সময় বদলানোর সাথে সাথে মানুষ বদলে যায়; বদলায় মানুষের চিন্তাভাবনা কিংবা দেখার ক্ষমতা। যে কারণে একই বই নানা সময়ে বারবার পড়তে হয়, বুঝতে হয়। ধরতে হয় বইটিকে।
যে কোনো লেখাকে বিচার-বিশ্লেষণ করার পূর্বশর্ত হলো নিরাবেগ হয়ে পড়া। এই কাজটা আমি খুব কম ক্ষেত্রেই করতে পারি। কিছু কিছু বিষয়ে আমার ব্যক্তিগত অবস্থান স্বতসিদ্ধ। তবে ছাপার অক্ষরে কিংবা কম্পিউটার স্ক্রিনে কোনো কিছু লেখার ক্ষেত্রে নিজের আবেগটুকু লুকিয়ে রেখে যুক্তির অংশটি তুলে ধরতে আমার চেষ্টার কমতি থাকে না; তবে সে চেষ্টা প্রায়ই বিফলে যায়। পড়ার ক্ষেত্রেও ইদানিং দেখছি যুক্তির ছাতাকে প্রায়ই আবেগের জোড়ালো বাতাস উড়িয়ে ফেলতে চায়। আবেগ ও যুক্তির এই দ্বৈরথ অনেকক্ষেত্রে একেবারেই মিলিয়ে যায়; অর্থাৎ আবেগ ও যুক্তির সহাবস্থান পরস্পরবিরোধী হয় না। তেমনই একটি নতুন ক্ষেত্র খুঁজে পেলাম এই ‘গাদ্দার’-এ।
‘গাদ্দার’ কী নিয়ে লেখা- সে আলোচনার দরকার নেই। ধারণা করি, প্রায় সবারই পড়া আছে বইটি। কিন্তু আমি বিহ্বল হয়ে যাই, গাদ্দারের কেন্দ্রীয় চরিত্রের জায়গায় নিজেকে কল্পনা করে। ভারতে যখন বাবরি মসজিদ ভাঙ্গা হলো, তখন আমি কিশোর। বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া সে সময়কার ঢেউ আমার মস্তিষ্কে প্রবল আলোড়ন তুলে নি সত্যি; কিন্তু মস্তিষ্কে বেশ বড়সড় প্রলেপই দিয়ে গেছে। এখনো মনে পড়ে, স্কুল বাদ দিয়ে, খেলা বাদ দিয়ে দিনের পর দিন আমাকে লুকিয়ে থাকতে হয়েছে- আতঙ্কে, ভয়ে। গাদ্দারের কেন্দ্রীয় চরিত্রের সঙ্গে আমার পার্থক্য এক্ষেত্রে সূচিত হয় কয়েকটি ক্ষেত্রে। প্রতিটি ক্ষেত্রের পার্থক্য মূলত মনস্তাত্ত্বিক। আর এই পার্থক্যই আমাকে ভুলতে চাওয়া বিএনপির ১৯৯১-এর সন্ত্রাসের কথা পুনরায় মনে করিয়ে দেয়। ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতনের প্রতিবাদে একটানা চার দিন শহীদ মিনারে যখন অনশন করে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম, তখন আমি জানি না কে আমাকে শহীদ মিনার থেকে জোর করে নিয়ে গিয়েছিল ঢাকা মেডিক্যালে, সেখান থেকে হলের বিছানায়। বৈজনাথকে দিনের পর দিন না খেয়ে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসতে হয়েছিল ভারতে, সেখানে আমার চার দিনের অনশন বৈজনাথের করুণতম অবস্থার সাথে কোনো অর্থেই তুলনীয় নয়; কিন্তু পঞ্চম দিনে যখন আমাকে জোর করে খাওয়ানো হয়েছিল, সেই অনুভূতির সাথে বৈজনাথের আখের রস খাওয়ার তৃপ্তিটুকু বোধহয় সমার্থক।
গাদ্দার আমি আবার পড়বো। হয়তো আরো বছর কয়েক পর। বৈজনাথের ঘৃণার তীব্রতা, বৈজনাথের আতঙ্ক, বৈজনাথের মানসিক অবস্থা আমার আরো ভালো করে জানা দরকার। নামসুবাদে কিছু পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হয়েছে আমাকে, এখনো যে ক্ষেত্রবিশেষে করতে হয় না- তা নয়। সেগুলোকে দৃঢ়ভাবে মোকাবিলার জন্যই আমাকে আবার পড়তে হবে এই গাদ্দারকে। তাই শেষ করে গাদ্দারের স্বগতোক্তি দিয়েই…
…কিন্তু দিন আসবেই। সেই শুভদিন আজ আসুক, কাল আসুক, একশো বছর পর আসুক, হাজার বছর কোনো গতি থেকে থাকে, যদি সংস্কৃতি ও সভ্যতার কোনো বিশেষ লক্ষ্যে উপনীত হবার সুদৃঢ় বাসনা থাকে, তবে অভীপ্সার কোন বিশেষ মূল্য থাকে, তবে সেই বাঞ্ছিত দিন অবশ্যই আসবে। সেদিন মানুষ সব দোষ ত্রুটির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করবে, নিজের কুপ্রবৃত্তি দূরে রাখতে সক্ষম হবে। প্রকৃতির প্রতি অণুপরমাণুর বুক চিরে তার কুৎসিত ভয়াবহতা দূর করে মানবতার বর্ণাঢ্য ও আকাঙ্ক্ষিত জগতে গিয়ে পৌঁছাবে। সেদিন অবশ্যই আসবে। সেদিন আসবেই।
বই পরিচিতি:
বইয়ের নাম: গাদ্দার
লেখক: কৃষণ চন্দর
অনুবাদ ও সম্পাদনা: আনোয়ারা বেগম
প্রকাশক: মুক্তধারা
প্রচ্ছদ-শিল্পী: কাইয়ুম চৌধুরী
Leave a Reply